প্রায় ৭ বছর পর আগামীকাল মঙ্গলবার (১৯ সেপ্টেম্বর) রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) শাখা ছাত্রলীগের চতুর্থ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নতুন কমিটি গঠনের লক্ষ্যে অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনের সার্বিক প্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছে শাখা ছাত্রলীগ। মঙ্গলবার সকাল ১০টায় রুয়েটের কেন্দ্রীয় অডিটোরিয়াম চত্ত্বরে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসাইন সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন।
এদিকে রুয়েট ছাত্রলীগের শীর্ষ পদ পেতে প্রত্যাশী নেতা-কর্মীরা কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ সম্ভাব্য নেতাদের কাছে দৌঁড়ঝাপ অব্যাহত রেখেছে। সবাই নিজেদের সাধ্যমত চালিয়ে যাচ্ছে লোবিং। নেতৃত্বে আসতে বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কিছু পদপ্রত্যাশী ছাত্রলীগ নেতার নাম এরই মধ্যে আলোচনায় উঠে এসেছে; যাদের কয়েকজনের বিতর্কিত বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন নেতৃত্বে আসার দৌঁড়ে এগিয়ে থাকাদের মধ্যে অন্যতম হলেন- বর্তমান কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য এবং রুয়েটের কম্পিউটার কৌশল বিভাগের ১৬ সিরিজের শিক্ষার্থী সৌমিক সাহা, রুয়েট ছাত্রলীগের উপ-গ্রন্থনা ও প্রকশনা সম্পাদক এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬ সিরিজের শিক্ষার্থী মো. ছালাতিজ্জোহা ইফতি, রুয়েট ছাত্রলীগের উপ-মানব সম্পদবিষয়ক সম্পাদক ইফতেখারুল হক দিগন্ত, উপ-দপ্তর সম্পাদক ও ইলেকট্রনিক এন্ড ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের ১৫ সিরিজের শিক্ষার্থী লাশিউর রহমান নাহিদ, কমিটির সহ-সভাপতি ও যন্ত্রকৌশল বিভাগের ১৪ সিরিজের শিক্ষার্থী এম.এম ওসমান হায়দার তমাল, রুয়েট ছাত্রলীগের আরেক সহ-সভাপতি ও পুরকৌশল বিভাগের ১৪ সিরিজের শিক্ষার্থী মো. ফাহমিদ লতিফ লিয়ন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রুয়েট ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ফাহমিদ লতিফ সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ নিয়ে ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনে রুয়েটের নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি ওই সময় রুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে সমস্ত ফুয়েল জুগিয়েছেন। ২০১৮ সালের ১২ এপ্রিল সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বেগবান করতে ‘রুয়েট কমন রুম’ নামের একটি ফেসবুক পেইজে লিখেছিলেন ‘আমরা আশা রাখি, যে যেই মতাদর্শের হই না কেন অন্যায় দেখকে বিরোধীতা করবো একসাথে। সবার উপরে দেশ, এই দর্শনটাই দেশটাকে পাল্টাতে পারে। অন্যায়-অবিচার নিপাত যাক, বাংলার মানুষ মুক্তি পাক।’
ফেসবুকে তার এমন পোস্ট দেখে ছাত্রলীগের অন্য নেতাকর্মীরা বিস্মিত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রুয়েট ছাত্রলীগের এক নেতা বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন কীভাবে বিতর্ক সৃষ্টি করেছিলো তা ছাত্রসমাজ জানে। আর রুয়েট ছাত্রলীগের সহ-সভাপতির দায়িত্বে থেকে লতিফ যেভাবে এই কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে উজ্জীবিত ছিলো এবং তিনি সরকারকে নিয়ে ফেসবুকে যেভাবে সমালোচনা করেছে তা মোটেও কাম্য নয়।
জানতে চাইলে রুয়েট ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মো. ফাহমিদ লতিফ লিয়ন বলেন, ‘আসলে কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরুর দিকে ছাত্রলীগই নেতৃত্বে ছিলো। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমিও রুয়েট ক্যাম্পাসে কোটা এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলাম। যখন দেখলাম, কোটা সংস্কার আন্দোলন ভিন্নখাতে প্রবাহিত হচ্ছে, তখনই আমি সেই আন্দোলন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। আসলে আমার বিরুদ্ধে কোনো ‘ক্লেম’ না পেয়ে আমার বিরোধীপক্ষ কোটা আন্দোলনটাকে সামনে আনার চেষ্টা করছে।’
আরেক সহ-সভাপতি লাশিউর রহমান নাহিদ যিনি আসন্ন সম্মেলনে শীর্ষ পদপ্রত্যাশীদের একজন। তার বিরুদ্ধেও মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া তিনি নর্দার্ন ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানিতে ইন্টার্ণশীপ প্রোগাম করছিলেন। গত নভেম্বর মাসে তিনি ক্যাম্পাস ছেড়েছিলেন। চলতি মাসের শুরুর দিকে সম্মেলনের তারিখ ঘোষণার পর ক্যাম্পাসে এসে আবারো ছাত্রলীগে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করেন। এই বিষয়ে জানতে নাহিদের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তার ব্যবহৃত নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
ছাত্রলীগের উপ-মানব সম্পদবিষয়ক সম্পাদক ইফতেখারুল হক দিগন্ত বেশ আলোচনায় রয়েছে। তবে ২০১৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি রুয়েটের বঙ্গবন্ধু শেখ মুবিজুর রহমান আবাসিক হলের গেস্ট রুমে তার বিরুদ্ধে কিছু অবৈধ মালামালসহ অসামাজিক কাজে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনায় তৎকালীন হল প্রভোস্ট পরের দিন এই বিষয়ে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে তিন কর্মদিবসের মধ্যে এর জবাব দিতে বলেন। কিন্তু পরবর্তীতে এই ঘটনার কোনো তথ্য-প্রমাণ না পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
জানতে চাইলে ছাত্রলীগের এই নেতা বলেন, ‘ওই দিন হলের গেস্টরুমে আরো বেশ কয়েকজন ছিলেন। সন্দেহের বশবর্তী হয়ে আমাকে কারণ নোটিশ দেয়া হয়েছিল। আমি যদি দোষী হতাম তাহলে তদন্তসাপেক্ষে আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো। আসলে সম্মেলনকে ঘিরে অনেকেই আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা-প্রপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে।’
ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য সৌমিক সাহা বলেন, ‘যোগ্য, সৎ এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে যারা সর্বদা সচেষ্ট থেকে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে এমন রানিং কোনো শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে নীতিনির্ধারকরা বসাবেন বলে প্রত্যাশা রাখি।’
রুয়েট ছাত্রলীগের উপ-গ্রন্থনা ও প্রকশনা সম্পাদক মো. ছালাতিজ্জোহা ইফতি বলেন, ‘যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রকৃত সৈনিক এবং রুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগকে আরো বেশি গতিশীল করতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করবে, এমন যোগ্য কেউ রুয়েট ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসবে বলে আশাবাদী।’
জানতে চাইলে রুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোহা. ইসফাক ইয়াসশির ইপু বলেন, আলোচনায় যারাই থাকুক না কেন রুয়েট ছাত্রলীগের নতুন কমিটিতে তাদেরই আসা উচিত যারা ছাত্রলীগের একমাত্র অভিভাবক দেশরত্ন শেখ হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করবে। একটি স্মার্ট ছাত্রলীগের ম্যান্ডেট নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করবে। তবে পরিচ্ছন্ন ইমেজ এবং সততা থাকতে হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়নে এদেশের যুবসমাজকে নিয়ে সামনের জাতীয় নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে বিজয়ী করে নিয়ে আসার যোগ্যতা যাদের থাকবে তাদেরকেই নেতৃত্বে আনা উচিত।’
রুয়েট ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে, রুয়েটের কেন্দ্রীয় অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিতব্য ছাত্রলীগের এই সম্মেলনে প্রধান অতিথি থাকবেন, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। রুয়েট ছাত্রলীগ সভাপতি মোহা. ইসফাক ইয়াসশির ইপুর সভাপতিত্বে সম্মেলনে প্রধান বক্তা থাকবেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান। রুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান তপুর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি থাকবেন, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী কামাল ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি ডা. আনিকা ফারিহা জামান অর্ণা।
উল্লেখ্য, রুয়েটে বর্তমানে ১৭ সিরিজের শিক্ষার্থীরা অনার্স/সমমানের শেষ বর্ষে অধ্যায়নরত। সেই হিসেবে ১৬ সিরিজের শিক্ষার্থীরা ২০২২, ১৫ সিরিজের শিক্ষার্থীরা ২০২১ সালে এবং ১৪ সিরিজের শিক্ষার্থীরা ২০২০ সালে রুয়েট থেকে পড়ালেখা শেষ করেছেন।