এবারের ডেঙ্গু অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বছরের শুরু থেকে জুন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা কিছুটা কম হলেও জুলাই থেকে বাংলাদেশ যেন এডিস মশা ও ডেঙ্গুর চারণভূমি হয়ে উঠছে। নবজাতক থেকে ৮০ বছর বয়সি কেউই বাদ পড়ছে না ডেঙ্গুর কবল থেকে। সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন প্রায় ৮০ হাজার (৭৯৫৯৮) মানুষ। এ মাসে প্রাণ গেছে ৩৯৬ জনের। গত ৯ মাসে ডেঙ্গুতে মৃত্যু এক হাজার ছাড়িয়ে গেল।
রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত স্বাস্থ্য বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ৯ মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১০০৬ জন। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায়ই মারা যান ১৭ জন। এ সময় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৮৮২ জন রোগী। এ নিয়ে এ বছর দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬ হাজার ২৮৮ জনে। রোগী ভর্তির এ সংখ্যাও সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের কোনো দেশেই ডেঙ্গুতে এত মৃত্যু হয়নি আগে। এমনকি বিশ্বে অধিক ডেঙ্গু সংক্রমণের শীর্ষে থাকা ব্রাজিলকেও ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। তারা মনে করেন, দেশের আবহাওয়া, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় ডেঙ্গুর ধরন এবং উপসর্গ বদলেছে। ডেঙ্গুতে জটিল রোগীদের মাল্টিপল অর্গান ফেইলিউর হচ্ছে। ফলে ৯০ ভাগ রোগীর প্রাণ যাচ্ছে ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে। দিন যত যাচ্ছে এই পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে বলে মত বিশ্লেষকদের। এবার বছরের মাঝামাঝি থেকে এডিস মশাবাহিত এ ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ভয়াবহ আকারে বাড়ার মধ্যে বছরের প্রথম নয় মাসেই তা হাজার ছাড়াল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর তথ্য রাখে। ওই বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৯৩ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৯ সালের আগে এ রোগে কখনোই ১০০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়নি। ২০১৯ সালে মারা যান ১৭৯ জন। পরের বছর আক্রান্ত ও মৃত্যু কম থাকলেও তা অনেক বাড়ে ২০২২ সালে; মৃত্যু হয় ২৮১ জনের। এতদিন পর্যন্ত যা ছিল বছরে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে জানুয়ারি মাসে ছয়জন মারা যান। ফেব্রুয়ারিতে তিনজন, এপ্রিল ও মে মাসে দুজন করে এবং জুন মাসে মারা যান ৩৪ জন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ১০০ ছাড়ায় ১৫ জুলাই। এরপর মৃতের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। দুই মাসের কিছু বেশি সময়ে মৃত্যু হয় আরও ৮০০ জনের। ২৫ জুলাই ২০০, ৫ আগস্ট ৩০০, ১৪ আগস্ট ৪০০, ২৩ আগস্ট ৫০০, ২ সেপ্টেম্বর ৬০০, ৮ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ৭০০, ১৬ সেপ্টেম্বর ৮০০ এবং ২৪ সেপ্টেম্বর ৯০০ ছাড়ায় ডেঙ্গুতে মৃত্যু। পরের ছয় দিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও একশ জনের মৃত্যু হয়েছে।
দেশে এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ৬৪৮ জন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলায় মৃত্যু হয়েছে আরও ৩৫৮ জনের। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি এবং মৃত্যুর তথ্য ঢাকার সরকারি ও বেসরকারি ৫৭টি হাসপাতাল এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন সিভিল সার্জন অফিস থেকে পাঠানো হয়।
অধিদপ্তর জানিয়েছে, রোববার সকাল পর্যন্ত নতুন ভর্তি রোগীদের মধ্যে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ২২৫৩ জন এবং ঢাকায় ৬১৯ জন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৯ হাজার ৩৫৭ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ৩১২০ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ৬২৩৭ জন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এ বছর যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের প্রায় সবাই ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে ভুগছিলেন এবং শক সিনড্রোমে মারা গেছেন বলে চিকিৎসকরা বলছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম যুগান্তরকে বলেন, ডেঙ্গুর চরিত্র বদলের জন্য তাৎক্ষণিক ডায়াগনোসিসে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। যেমন- ডেঙ্গু টেস্টে নেগেটিভ ফলাফল আসছে। উপসর্গও ডেঙ্গুর মতো নয়। কিন্তু হঠাৎ করে রোগীর শারীরিক পরিস্থিতি খারপ হচ্ছে। এতে রোগীরা যেমন বুঝে উঠতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকরাও বুঝে উঠতে পারছে না। এই দুইয়ের মাঝে থেকে কিছু রোগীর জটিলতা তৈরি হচ্ছে। বেশিরভাগের দেখা যাচ্ছে ডেঙ্গু হেমোরজিক ফিভার হচ্ছে। হঠাৎ করে শরীরে ফ্লুইড লস তথা রক্তের জলীয় অংশ কমে যাচ্ছে। রোগী শকে চলে যাচ্ছে। ডেঙ্গুর কোন চরিত্রের কারণে এমনটা হচ্ছে, সেটি নিয়ে গবেষণা দরকার।
ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালের পরিচালক কর্নেল একেএম ডা. জহিরুল হোসাইন খান বলেন, ডেঙ্গুতে শক সিনড্রোমে চলে যাওয়া রোগীদের যত দ্রুত ম্যানেজমেন্ট দরকার। তা হচ্ছেও। অনেক রোগী দেরি করে হাসপাতালে আসছে। ততক্ষণে শরীরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বিকল হয়ে যাছে। দ্রুত মৃত্যু হচ্ছে।
এত মৃত্যুর কারণ হিসাবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন মনে করেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তির দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনে জ্বর ভালো হয়ে যায়। কিন্তু পঞ্চম বা ষষ্ঠ দিনে ফের অসুস্থ হচ্ছে। এছাড়া অনেকে আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেও সেটি বুঝতে পারেনি। তারা দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার আক্রান্ত হওয়ায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, এই রোগীদের দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া ও পরীক্ষা করা দরকার। কিন্তু প্রথমে বুঝতে না পারায় দ্রুত শকে চলে যাচ্ছে। সেটি জানারও ব্যবস্থা নেই। মূলত অব্যবস্থাপনার কারণেই রোগী বেশি মারা যাচ্ছে।