ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা ভালো নেই। ডলার সংকটে আমদানি এখন নিয়ন্ত্রিত, রপ্তানিতে শ্লথগতি, রেমিট্যান্স প্রবাহেও ভাটার টান চলছে। দুর্বল মুদ্রানীতি ও খেলাপি ঋণের ভারে বিশৃঙ্খলা চলছে আর্থিক খাতে, পুঁজিবাজারেও চলছে মন্দা। অন্যদিকে জিনিসপত্রের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে ভোগ কমিয়ে দিয়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা, এতে কমে যাচ্ছে চাহিদা। বিনিয়োগে স্থবিরতায় কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থানও হচ্ছে না। সব মিলিয়ে কঠিন সময় পার করছে দেশের অর্থনীতি। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রকাশের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে অর্থনীতির দুরবস্থার চিত্রই তুলে ধরল বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি জানিয়েছে, চলতি অর্থবছর (২০২৩-২৪) বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ।
প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের এই পূর্বাভাস সরকারনির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম। চলতি অর্থবছরের বাজেটে সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। তবে অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে বিশ্বব্যাংক আভাস দিচ্ছে, এই অর্থবছরে সরকারনির্ধারিত প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। বিশ্লেষকেরাও মনে করেন, বিশ্বব্যাংকের এমন পূর্বাভাস যৌক্তিক। কারণ, অর্থনৈতিক সূচকগুলোর গতিপ্রকৃতি এখন বেশ নড়বড়েই বলা যায়।
কোনো দেশের অর্থনীতি এক বছরে কতটা বড় হয়, সেটা বোঝা যায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি দিয়ে। অর্থনীতি যখন ভালো থাকে, তখন প্রবৃদ্ধির হার বেশি হয়। আর অর্থনীতি খারাপ থাকলে তখন প্রবৃদ্ধির হার কম হয়। বিশ্বব্যাংকের ঘোষিত পূর্বাভাস বলছে, এ অর্থবছরেও অর্থনীতি এগোবে। তবে তা সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী নয়। এমন রক্ষণশীল পূর্বাভাস দেওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণও তুলে ধরেছে সংস্থাটি।
গতকাল আগারগাঁওয়ে নিজস্ব কার্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক বাণিজ্যের চাপ, আর্থিক খাতের ঝুঁকি, দুর্বল মুদ্রানীতি ও বিনিময় হার, খেলাপি ঋণ, সুদহারের সীমা, অত্যাবশ্যকীয় আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ, দুর্বল রাজস্ব আদায় ব্যবস্থাপনার কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে দেশের অর্থনীতি। এসব দুর্বলতাই জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমাবে। তাই সংস্থাটি বাংলাদেশের অর্থনীতির ধারা বজায় রাখতে আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন খাতে সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছে।
বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রকাশ অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুলায়ে সেকসহ আরও উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির মুখ্য অর্থনীতিবিদ বার্নার্ড হ্যাভেন এবং যোগাযোগ বিভাগের প্রধান মেহেরিন এ মাহবুব। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ নাজমুস সাদাত খান।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়েছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। আগামী দিনেও উচ্চ মূল্যস্ফীতির ধারা অব্যাহত থাকতে পারে। দেশে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য চারটি বিষয়কে দায়ী করেছে বিশ্বব্যাংক। সেগুলো হচ্ছে অভ্যন্তরীণ জ্বালানির মূল্য বেড়ে যাওয়া, দুর্বল মুদ্রানীতি, টাকার অবমূল্যায়ন ও ডলার সংকটে আমদানি কমে যাওয়া।
বিশ্বব্যাংকের ঘোষিত পূর্বাভাস কতটা যৌক্তিক, জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে। সেগুলো মাথায় রেখে বিশ্বব্যাংক তাদের পূর্বাভাস দিয়েছে। রিজার্ভ নিচের দিকে নামায় আমদানিতে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিতে হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে বিনিয়োগে ও ঋণে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বিনিয়োগের লভ্যতা কমে যাচ্ছে। মানুষের চাহিদা কমে যাচ্ছে। সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।’
ড. মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, ‘এটা তো প্রথম প্রান্তিক গেল। আমাদের দেখতে হবে, অন্যান্য প্রান্তিকে বাংলাদেশের অর্থনীতি কী পরিস্থিতিতে দাঁড়ায়। এখনকার পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, বিশ্বব্যাংক যে পূর্বাভাস দিয়েছে, তার কাছাকাছিই থাকবে।’
এদিকে বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে অর্থনীতিতে কিছু সংস্কারের পরামর্শও দিয়েছে বিশ্বব্যাংক; বিশেষ করে বিনিময় হারকে ধরাবাঁধার বাইরে রাখা, মুদ্রানীতি আধুনিক করা এবং রাজস্ব খাতের সংস্কারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সংস্থাটির মতে, অর্থনীতিতে এখন বিভিন্ন ধরনের বাধা কাজ করছে। ফলে ঝুঁকিও ক্রমশ বাড়ছে। তবে মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে পারলে এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক করা সম্ভব হলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়ে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে বলেও জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
গতকালের অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং টাকার অবমূল্যায়নের কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে। মানুষের ভোগও চাপের মুখে পড়েছে। এ ছাড়া মজুরি বৃদ্ধির তুলনায় খাবারের দাম বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে মুদ্রানীতির কার্যকর ব্যবহারের ওপর জোর দেন তিনি।
বিশ্বব্যাংকের এই কর্মকর্তা বলেন, চ্যালেঞ্জের মধ্যেও বাংলাদেশ বহুমাত্রিক অগ্রগতি অর্জন করেছে; বিশেষ করে দারিদ্র্য বিমোচনে। সামাজিক অনেক ক্ষেত্রেও উন্নত হয়েছে। বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে হবে। মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে সুদহারের সীমা পর্যায়ক্রমে তুলে দিতে হবে। এ ছাড়া ব্যাংক খাতের কার্যকর তদারকির মাধ্যমে আর্থিক খাতের ঝুঁকি কমানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক সহায়তা দিতে প্রস্তুত বলেও জানান তিনি।
নির্বাচন ঘিরে শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের সব দেশেই একটি পরিস্থিতি বিরাজ করে। তবে এবারের নির্বাচন অর্থনীতিতে ঝুঁকি বাড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা নির্বাচন পরিস্থিতি বুঝে বিনিয়োগ করবে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক।
অনুষ্ঠানে দক্ষিণ এশিয়ার জিডিপির তথ্যও প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, চলতি অর্থবছরে ভারতের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। ভুটানের ৪ শতাংশ, নেপালের ৩ দশমিক ৯ শতাংশ এবং পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ১ দশমিক ৭ শতাংশ।