নভেম্বরের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে বলে নির্বাচন কমিশন জানান দিয়েছে। তাই বিএনপি চাইছে তফসিল ঘোষণার আগেই আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার হটানোর এক দফা দাবিতে সাফল্য পেতে। আর আওয়ামী লীগ চাইছে যে কোনোভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করতে। তাই এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে সক্রিয় থাকা ক্ষমতাসীন দল ও বিএনপিসহ সমমনা বিরোধী জোট অক্টোবর-নভেম্বর মাসকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। ফলে সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতা ভয়াবহ রূপ নেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রও সহিংসতার আশঙ্কা করছে। বৈশ্বিক বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে এই আশঙ্কার কথা জানানো হয়। বলা হয়েছে, ২০২৩ এর শেষ বা ২০২৪ সালের শুরুতে জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা বাড়তে পারে। নির্বাচনকে ঘিরে দেশে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের আশঙ্কা করছেন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংগঠন বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা।
উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতিতে রাজপথের সহিংসতা রুখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য ঠেকাতে নেওয়া হয়েছে নানামুখী কৌশলী কর্মপরিকল্পনা। আগাম প্রস্তুতি হিসেবে বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা তৎপরতা। দেশের সর্বত্র এলাকাভিত্তিক সন্ত্রাসীদের তালিকা তৈরি করছের্ যাব। গ্রেপ্তার করা হচ্ছে রাজপথের নাশকতা সৃষ্টিকারী চিহ্নিত অগ্নিসন্ত্রাসী ও বোমাবাজদের। বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিদের গ্রেপ্তারেও বাড়ানো হয়েছে নানামুখী তৎপরতা। নির্বাচন কেন্দ্রিক সহিংসতা ঠেকানোর আগাম প্রস্তুতি হিসেবে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান জোরদার করা হয়েছে। চোরাপথ দিয়ে অবৈধ গোলা-বারুদ যাতে দেশে ঢুকতে না পারে এজন্য বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি) সীমান্ত এলাকায় সব ধরনের টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করেছে।
এ প্রসঙ্গের্ যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, নির্বাচনের আগে অস্ত্র চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যেতে পারে। বর্তমানে মাঠে যে নির্বাচনী উত্তাপ আছে তার চেয়ে সামনের দিনগুলো আরও কঠিন হতে পারে, তবের্ যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর।
এ বিষয়ে গোয়েন্দারা মাঠে কাজ করছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন) মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, অবৈধ অস্ত্রের বিরুদ্ধে পুলিশের নিয়মিত অভিযান চলমান। এছাড়া সবগুলো ইউনিটকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং প্রতিনিয়ত পুলিশ সদর দপ্তর থেকে মনিটরিং করা হচ্ছে। যারাই অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার করবে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা জানান, বাংলাদেশে এবারের নির্বাচন নিয়ে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে দেশি-বিদেশি শক্তিগুলো অনেক বেশি সক্রিয়। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বাধাদানকারী সরকার ও বিরোধী দলের রাজনীতিক এবং প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের ওপর ভিসা নীতির প্রয়োগ শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপীয় ইউনিয়নেও বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ে আলোচনার প্রস্তাব তোলা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার সংসদে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন একজন সংসদ সদস্য। সব মিলিয়ে নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিদেশিদের তৎপরতা বাড়তে শুরু করেছে। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনের আগে-পরের রাজনৈতিক সহিংসতা রুখতে গিয়ে যাতে বিদেশিদের নিষেধাজ্ঞার ফাঁদে পড়তে না হয় এজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী হার্ডলাইনে যাওয়ার পরিবর্তে কৌশল ছক এঁটে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে।
পুলিশের ডিআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা জানান, দুর্গাপূজার পরপরই হয়তো বিএনপি 'অল আউট' কর্মসূচিতে নামবে। তাদের মোকাবিলায় আওয়ামী লীগও নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে। এতে বড় ধরনের সহিংসতার আশঙ্কা রয়েছে। তাই আগেভাগেই এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। যাতে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টির সুযোগ যতটা সম্ভব আগেই কমানো যায়। একই সঙ্গে যে কোনো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দ্রম্নত সামাল দেওয়ারও প্রস্তুতি রাখার জন্য মাঠপর্যায়ের পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানায়, আগামী ১৮ অক্টোবর ঢাকায় জনসমাবেশ করবে বিএনপিসহ সরকারবিরোধীরা। সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্তি, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ও বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির এক দফা দাবিতে যুগপৎভাবে এই কর্মসূচি পালিত হবে। জনসমাবেশটি মহাসমাবেশের আদলে সর্বাত্মকভাবে সফল করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। জনসমাবেশ থেকে এক দফা দাবি মেনে নিতে সরকারকে আলটিমেটাম দেওয়া হতে পারে। আলটিমেটাম কাজ না হলে ঢাকামুখী শক্ত কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। তফসিল ঘোষণার পরপরই হরতাল ডাকতে পারে বিএনপি। এমনকি সারা দেশ থেকে নেতাকর্মীদের ঢাকায় এনে অবস্থান কর্মসূচি ও সচিবালয় ঘেরাও করার মতো কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে সরকারবিরোধী এ দলটি।
তাই রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আগাম সতর্ক করা হয়েছে। কেউ যাতে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে না পারে সেজন্য আগে থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা এবং আগাম গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। যাতে কেউ ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগের মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আন্দোলনের নামে যদি কেউ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করে তবে যাতে দ্রম্নত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যায় এজন্য তোড়জোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তবে পুলিশ আশাবাদী, সব রাজনৈতিক দলই নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করবে; ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকবে। তবে কেউ যদি এ ধরনের অপচেষ্টা চালায় তবে পুলিশ বরাবরের মতো তা শক্ত হাতে দমন করবে।
পুলিশের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, একটি গণতান্ত্রিক দেশে কোনোভাবেই অস্থিতিশীলতা কাম্য না। দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের এ যাত্রা যাতে অব্যাহত থাকে; বিদেশি বিনিয়োগ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, বিশ্বের কাছে যেন অস্থিতিশীল দেশের নমুনা হিসেবে ব্যবহৃত না হতে হয় সেজন্য পুলিশ প্রয়োজনীয় সবকিছুই করবে। কেউ যদি এমন কিছু করার চেষ্টা বা চক্রান্ত করে তার বিরুদ্ধে আইনগত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ক্ষেত্রে কাউকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অপরাধ পর্যালোচনা সভাতেও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এসব বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার সবাইকে সতর্ক থাকার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দিয়েছেন। জামায়াত-শিবির কিংবা কোনো বিশেষ অপশক্তি রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে যাতে তান্ডব চালাতে না পারে সেদিকে সবাইকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।