‘ব্র্যান্ড বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর


, আপডেট করা হয়েছে : 15-10-2023

‘ব্র্যান্ড বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চামড়ার জুতো ও চামড়াজাত পণ্য শিল্পের ব্যবসায়ীদের এ খাতের জন্য ‘চামড়া উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ গঠনের ঘোষণার পাশাপাশি ‘ব্র্যান্ড বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার প্রতি মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের পণ্য আমাদের নিজের নামে বাজারজাত করা হোক। আমাদের দেশের নাম বাড়ুক। আমি চাই, বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল হোক, বড় হোক।’


বৃহস্পতিবার (১২ অক্টোবর) বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে চতুর্থ বাংলাদেশ লেদার ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদারগুডস ইন্টারন্যাশনাল সোর্সিং শো (ব্লিস) ২০২৩ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন সরকারপ্রধান।


শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি জানি, অনেক দেশের অনেক পণ্য তারা এখান থেকে তৈরি করে নিয়ে গিয়ে নিজেদের দেশে ফিনিশিং দিয়ে নিজেদের নামে বাজারজাত করে। সেক্ষেত্রে আমরা নিজেরাও নিজেদের কিছু কিছু ব্র্যান্ড তৈরি করতে পারি কি না বাংলাদেশ ব্র্যান্ড হিসেবে, আমার মনে হয় সেদিকেও নজর দিলে ভালো হয়। এক্ষেত্রে আমাদের সরকারের কাছ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা পাবেন।’


প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্পের রপ্তানিকারকদের উচ্চমূল্য সংযোজন করে বিশ্বের বিভিন্ন স্বনামধন্য ব্র্যান্ডের ও ক্রেতাদের ক্রয় আদেশ সম্পাদন সক্ষমতা এবং ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক সুউচ্চ গুণগতমান সম্পূর্ণ বৈচিত্রময় পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি করছে বাংলাদেশ।’


সরকারপ্রধান বলেন, ‘যেহেতু অর্থনৈতিকভাবে আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে, দারিদ্রের হার কমেছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে এবং আমাদের নিজস্ব বাজার তৈরি হচ্ছে। আমাদের দেশের মানুষই এখন পণ্য ক্রয় করে। অতীতে যেখানে মানুষের পায়ে একটি রবারের চপ্পলও ছিল না, এখন কিন্তু সেটা আর দেখা যায় না। পাশাপাশি, সরকার রাস্তা-ঘাটের উন্নয়ন করে দেওয়ায় এখন আর কাদামাটি ঠেলেও বেশি চলতে হয় না।’


প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এবারের ব্লিস-এর থিম—পসিবল ইন বাংলাদেশ (বাংলাদেশেও সম্ভব) সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বাংলাদেশের যে অভূতপূর্ব উন্নয়নমূলক রূপান্তর ঘটেছে, তা এতে যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।’


উদ্যোক্তাদের এজন্য ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, এই বাংলাদেশেও সম্ভব।’  


আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে চামড়া শিল্পে গৃহীত বিভিন্ন তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তনের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রথমত, বাণিজ্যিক খামার সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং গবাদি পশু পালনে বিপ্লব ঘটেছে, যার ফলে দেশ কোরবানির মৌসুমেও গবাদি পশুর চাহিদা পূরণে সক্ষম হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে বছরে ২৫ লাখ গবাদি পশু উৎপাদিত হচ্ছে।’


শেখ হাসিনা বলেন, ‘দ্বিতীয়ত, মাত্র এক দশক আগে দেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগই আসত কাঁচামাল হিসেবে চামড়া রপ্তানি থেকে, কিন্তু সরকারের প্রণোদনা ও নীতিগত সহায়তায় উচ্চমূল্য সংযোজন পণ্য উৎপাদন যেমন পাদুকা ও চামড়াজাত পণ্য শিল্পের সম্প্রসারণ হয়েছে। এখন এ খাতের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৯৩ শতাংশ আসছে পাদুকা ও চামড়াজাত পণ্য থেকে।’


সরকারপ্রধান বলেন, ‘তৃতীয়ত, হাজারীবাগের পরিবেশগত সমস্যার সমাধানে আমাদের সরকারই সক্রিয় পদক্ষেপ নিয়ে ট্যানারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিপূর্ণভাবে সাভারে আধুনিক শিল্পনগরীতে স্থানান্তর করেছে।’


প্রধানমন্ত্রী অতি দ্রুত সাভারের কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) আন্তর্জাতিক কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেশন তথা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) ও সাসটেইনবল লেদার ফাউন্ডেশন (এসএলএফ) ইত্যাদি অর্জন উপযোগী করতে প্রয়োজনীয় সবকিছু সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন। এক্ষেত্রে যেহেতু বেপজা কর্তৃপক্ষের একটি বিশ্বমানের ইটিপি পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা রয়েছে, সেহেতু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে একটি ‘চামড়া উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দেন তিনি।


শেখ হাসিনা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে একটি পৃথক চামড়া উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ করে দেওয়া হবে। যাতে এই খাতের ছোটখাটো নানান সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব হয়।’


প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই খাতের সমস্যা সমাধানে এবং কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণে অঞ্চলভিত্তিক অত্যাধুনিক কসাইখানা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ট্যানারি শিল্প গড়ে তোলার চিন্তা-ভাবনা সরকারের রয়েছে।’ সেক্ষেত্রে ঢাকার সাভারের পর চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর নাম উল্লেখ করেন তিনি।


শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে চামড়া শিল্পখাতের উন্নয়নে সুপারিশ প্রদান ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ণের লক্ষ্যে টাস্কফোর্স গঠন করেছি। আমরা চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য উন্নয়ন নীতিমালা ২০১৯ ও চামড়া খাতের রপ্তানি রূপরেখা ২০২২ প্রণয়ন করেছি। আমাদের ক্রমবর্ধমান সরবরাহের পুরোটাই ফিনিশড প্রডাক্ট তৈরি করে রপ্তানি করতে পারলে আমরা অনায়াসে ২০২৫ সালের মধ্যে চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা খাত থেকে তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় অর্জন সম্ভব হবে।’ তবে পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র আনয়ন এবং রপ্তানি পণ্যের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রতিও তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন।


শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি চাই, ২০৩০ সাল নাগাদ এ খাত থেকে সামগ্রিক রপ্তানি আয় যেন ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়। এজন্য আমাদের সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে।’


এ বিষয়ে অতি সত্বর, সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার জন্যও সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দেন সরকারপ্রধান।


প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে স্পিড টু মার্কেট নিয়ে কাজ শুরু করেছি। রপ্তানির লিড টাইম ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসতে আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত প্রক্রিয়া ও সেবা আরও সহজ করা হবে।’


প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘সাধারণ বন্ড সুবিধার আওতায় আমদানিকারকদের স্টকহোল্ডিংয়ের জন্য কমন বন্ডেড ওয়্যার হাউজ পদ্ধতি প্রবর্তন। এর ফলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাও বন্ড সুবিধা ভোগ করতে পারবে। আমদানি সহজ, আমদানি ব্যয় হ্রাস ও লিড টাইম কমে আসবে।’


‘প্রচলিত লাল ফিতার ধারণার অবসান হলে ব্যবসা-বাণিজ্যে আরও গতিশীলতা আসবে এবং দেশ আরও উন্নত হবে’ উল্লেখ করে সরকারপ্রধান আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পরিহারের আহ্বান জানান।


শেখ হাসিনা বলেন, ‘দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং তা বস্তাবায়নও দ্রুত করতে হবে। একটু আটকে রাখলে বা টাইট দিলে ভালো হয় কেউ কেউ মনে করেন। আসলে সবসময় তা ভালো হয় না। দ্রুত সিদ্ধান্ত, দ্রুত বাস্তবায়ন—এই নীতিতেই আমি বিশ্বাসী। কাজের ক্ষেত্রে এই লাল ফিতার দৌরাত্ম্য যেন আর না থাকে। আমাদের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকেও আমি বলব, একটু আন্তরিক হলেই সিদ্ধান্ত দ্রুত কার্যকর করা যেতে পারে। কারণ, নষ্ট করার মতো সময় নেই, টাইম ইজ টু শর্ট। সেটা যেমন মাথায় রাখতে হবে, তেমনি দেশকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’


প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কোভিড-১৯ অতিমারি এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে সৃষ্ট বিশ্বমন্দা না হলে দারিদ্রের হার সরকার ১৮ দশমিক ৬ ভাগে যে নামিয়েছে, তার থেকে অন্তত দুইভাগ হলেও বেশি কমাতে পারত এবং হতদরিদ্রের হার ১৫ ভাগ থেকে ৫ ভাগে নামিয়েছে। আগামীতে দেশে আর কেউ হতদরিদ্র থাকবে না। অন্তত মানুষ যেন খেয়ে পরে ভালোভাবে বাঁচতে পারেন, সে ব্যবস্থাই আওয়ামী লীগ সরকার করে দিচ্ছে।’


প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘ইকোনমিক ডিপ্লোমেসির এই যুগে সরকার আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যকে ত্বরান্বিত করতে এবং নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করতে চেষ্টা করছে। কারণ, আমাদের গভীর সমুদ্রবন্দর হয়ে গেলে সরাসরি কার্গো পাঠানো যাবে, সে ব্যাপারেও কাজ হচ্ছে।’


সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমরা সারা দেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছি। যার ফলে বাংলাদেশ বিশ্বে এখন বিনিয়োগ ও সোর্সিংয়ের জন্য সর্বাধিক অনুকূল গন্তব্য হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান আন্তর্জাতিক বিমান পরিচালনা রুটের মধ্যে পড়ায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের একটি সেতুবন্ধ হতে পারে বাংলাদেশ। সেভাবেই বাংলাদেশকে উন্নত করা হচ্ছে।’


শেখ হাসিনা তার সরকারকে ‘ব্যবসাবান্ধব’ আখ্যায়িত করে দেশে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলায় বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেন। তিনি কর্মস্থলে মালিকদের শ্রমবান্ধব পরিবেশ এবং শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করার আহ্বানও পুনর্ব্যক্ত করেন।


সরকার ব্যবসার পরিবেশ সহজীকরণ ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ এবং ব্যবসায়ের চড়া খরচ ‘কস্ট অব ডুইং বিজনেস’ যাতে বৃদ্ধি না পায় সেদিকে যেমন নজর দেবে, তেমনি ব্যবসায়ীদের ইউটিলিটি বিলগুলো যথাসময়ে পরিশোধের জন্য প্রধানমন্ত্রী আহ্বান জানান।


ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধ না হতেই ফিলিস্তিনে ইসরাইলের আগ্রাসনের উল্লেখ করে এই যুদ্ধ বন্ধ করার জন্যও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।


অনুষ্ঠানে আরও বক্তৃতা দেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ, অ্যাডভান্সড ম্যানুফ্যাকচারিং গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান জোনাথন ববেট এবং গোল্ডেন চ্যাং গ্রুপের বিনিয়োগকারী ও প্রতিষ্ঠাতা জেমস হো। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর।


বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এলএফএমইএবি) যৌথভাবে রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় ১২ থেকে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক এই প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে।



  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার