দিনের পর দিন নকল হচ্ছে প্রাণরক্ষাকারী নানা ওষুধ। এসব বিক্রি হচ্ছে পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে গ্রামের হাটবাজারে। এ ধরনের কিছু ওষুদ নামি-দামি ফার্মেসিতে মিলছে। ওষুধ প্রশাসন ও আইশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রায়ই অভিযান চালানো হচ্ছে নকল ওষুধের বিরুদ্ধে। কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না এর উৎপাদন ও বাজারজাত। গ্রেফতারের পর ছাড়া পেয়ে আবারও পুরোনো পেশায় ফিরছে চক্রের সদস্যরা। এ ধরনের চক্রের ৭২ সদস্যকে চিহ্নিত করছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার বিভিন্ন ইউনিট। এ ধরনের অপরাধীদের বিরুদ্ধে দ্রুত নতুন আইন প্রয়োগ হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
চক্রের যেসব সদস্যকে চিহ্নিত করা হয়েছে তাদের মধ্যে আছেন-কবির হোসেন, মোরশেদ আলম শাওন, নাজিম উদ্দিন, আল-আমিন চঞ্চল, তৌহিদ, সাগর, আবির, রুবেল, পারভেজ, আইনুল ইসলাম, তরিকুল ইসলাম, সৈয়দ আলী মাসুদ, সাইদুল ইসলাম, আনোয়ার, আব্দুল লতিফ, নাজমুল ঢালী, সাগর আহমেদ মিলন, তামিম, ইমরান, জাকির, রবিউল, পারভেজ, মাখন, আক্কাস, নাসির উদ্দিন, আওলাদ, ফয়সাল, শরিফ হোসেন, জাহিদ, সোহাগ হোসেন, মিজানুর রহমান, সালাউদ্দিন, ইমন, শফিক, সরদার মারুফ, জুয়েল, আলাউদ্দিন, জাহাঙ্গীর প্রমুখ।
সূত্র জানায়, ওষুধ প্রশাসনের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে বেপরোয়া দুষ্টচক্রের সদস্যরা। আদালত যেসব কোম্পানির ওষুধ নিষিদ্ধ করেছে সেগুলোও বাজারে বিক্রি হচ্ছে। ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতেও জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছে অসাধু চক্র। কাঁচামাল আমদানির নামে অনেকে অর্থ পাচারে জড়িয়ে পড়েছে। সরকারিভাবে দেশে ওষুধের কাঁচামাল তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হলেও রহস্যজনক কারণে সেটি থমকে আছে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক আসরাফ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, নকল ও ভেজাল ওষুধ চক্রের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান। এই চক্রের সঙ্গে ওষুধ প্রশাসনের কারও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে আমার জানা নেই। কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে চাকরিচ্যুতও করা হতে পারে।
সূত্র জানায়, ভেজাল ওষুধ তৈরির অভিযোগে কয়েক মাস বেশ কয়েকটি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানকে নিষিদ্ধ করেন আদালত। ওইসব কোম্পানিকে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর নোটিশ দিয়ে দ্রুত তাদের ওষুধ বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এখনো বাজারে বিক্রি হচ্ছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অসৎ কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই এসব ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রি কর হচ্ছে বলে যুগান্তরের কাছে অভিযোগ করেন প্রতিষ্ঠিত ওষুধ কোম্পানির মালিক। তিনি জানান, ড্রাগ লাইসেন্স নবায়ণ, নতুন লাইসেন্স প্রদান, প্রকল্প হস্তান্তর বা স্থানান্তর, রেসিপি অনুমোদন, ওষুধ নিবন্ধন, নমুনা পরীক্ষা ও মান নিয়ন্ত্রণ এবং রপ্তানি নিবন্ধনসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে ওষুধ প্রশাসনের কতিপয় কর্মকর্তা ঘুস নেন। সম্প্রতি একটি ফার্মাসিটিক্যালস কোম্পানির পক্ষ থেকে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির সভাপতির কাছে পৃথক দুটি লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, ‘একটি নকলবাজ চক্র ২০১৭ সাল থেকে নকল ন্যাপ্রোক্সেন প্লাস ৫০০+২০০ ট্যাবলেট তৈরি করে বাজার সয়লাব করে দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ওষুধ প্রশাসনের কাছে অসংখ্যবার অভিযোগ করেছি। প্রতিটি জেলায় কর্মরত ওষুধ প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বারবার বিষয়টি জানিয়েছি। এছাড়া জেলা প্রশাসক, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, র্যাব, ডিবি এবং পুলিশ প্রশাসনকে লিখিতভাবে জানিয়েছি। দেশের বিভিন্ন থানায় ৬৫টি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছি। বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে অনেককে হাতেনাতে গ্রেফতারও করেছে। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ নকল ওষুধও উদ্ধার করা হয়েছে। এরপরও বন্ধ হচ্ছে না নকল ও ভেজাল ওষুধ প্রস্তুতকারী এবং বিক্রেতাদের দৌরাত্ম্য।’
ওষুধের কাঁচামাল আমদানির নামে বিদেশে অর্থ পাচার এবং ভেজাল ওষুধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইনগত বব্যস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপুলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ যুগান্তরকে বলেন, পাচারকারী এবং ভেজাল ওষুধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আমরা যখনই অভিযোগ পাই তখনই অভিযান চালাই। এছাড়া গোয়েন্দা তথ্যের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে প্রায়ই ভেজাল ওষুধ জব্দ করছি। জড়িতেদের গ্রেফতার করছি। কিন্তু পরে তারা আদালত থেকে জামিন পেয়ে একই ধরনের অপতৎপরতায় লিপ্ত হচ্ছে।
ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, গত বছরের ৫ জুন রাজধানীর মিটফোর্ড, সাভার এবং কুমিল্লার হিমালয় ল্যাবরেটরিতে অভিযান চালিয়ে ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ভেজাল ন্যাপ্রোক্সেন প্লাস ৫০০+২০০ ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর ডিবি পুলিশের কোতোয়ালি জোনাল টিম ঢাকা ও সাভার এলাকায় অভিযান চালিয়ে সাতজনকে গ্রেফতার করে। ওই অভিযানে ওষুধ তৈরির নকল কারখানা আবিষ্কার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে ন্যাপ্রোক্সেন প্লাস ৫০০+২০০ ছাড়াও বিপুল পরিমাণ নকল মোনাস-১০, সেকলো-২০, মাইজিড-৫০০, থিজা-৫০০, এমটিএক্স ২৫, এক্সকেল, ইটোরিকক্সিব ও ভেজাল ওষুধ তৈরির যন্ত্রপাতি উদ্ধার করা হয়। তিনি আরও বলেন, নকল ওধুষ চক্রের বেশকিছু সদস্যকে আমরা চিহ্নিত করেছি। রাজনৈতিক সহিংসতা মোকাবিলায় ব্যস্ত থাকার কারণে এই মুহূর্তে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে পারছি না। শিগগিরই অভিযান চালিয়ে চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় আনা হবে।
পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নকল ও ভেজাল ওষুধের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে যেসব থানায় দুষ্টচক্রের বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে সেগুলোর মধ্যে আছে, পটুয়াখালী সদর, বরিশাল কোতোয়ালি ভোলা সদর, মতিঝিল মডেল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর, চুয়াডাঙ্গা সদর, জীবননগর, খুলনা সদর, কালীগঞ্জ, নরসিংদী মডেল, জামালপুর সদর, ময়মনসিংহ কোতোয়ালি, মেহেরপুর সদর, গাজীপুরের বাসন, চট্টগ্রামের বোয়ালখালী, কক্সবাজার সদর, নোয়াখালীর মাইজদী, সুদারাম মডেল, দিনাজপুর কোতোয়ালি, রংপুর কোতোয়ালি, দিনাজপুর সদর, চাঁদপুর সদর, রাজাপাড়া, লক্ষ্মীপুর মডেল, বরগুনা কোতোয়ালি, সিলেট কোতোয়ালি প্রভৃতি।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের উপপরিচালক নূরুল আলম বলেন, ওষুধের কাঁচামাল আমদানির অনুমোদন যাকে-তাকে দেওয়া হয় না। তাই ওষুধের কাঁচামাল আমদানির নামে অর্থ পাচার এত সহজ নয়। হেভিওয়েট কেউ এ ধরনের কিছু করেছে বলে আমাদের জানা নেই। সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেব। তিনি বলেন, নকল-ভেজাল ওষুধের বিষয়ে আমরা বেশ কনসার্ন। আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ৭ সেপ্টেম্বর নতুন আইন পাশ হয়েছে। ওই আইনে নকলবাজ ও ভেজালকারীদের যাবজ্জীবন শাস্তির বিধান করা হয়েছে। নতুন আইন প্রয়োগের জন্য আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি।