২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কমিউনিটি পুলিশিং ও বিট পুলিশিং এর মাধ্যমে সারা দেশে বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে ১ লাখ ৯৩ হাজার ৯৪৪টি। দেশব্যাপী ৬ হাজার ৫২৫টি বিটের মাধ্যমে ৪৯ হাজার ৫২৯ টি কমিটিতে কাজ করছেন ৮ লাখ ৯৪ হাজার ২০৬ জন সদস্য। অপরাধ নিয়ন্ত্রণ এবং পুলিশের সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই কমিউনিটি পুলিশিং চালু করা হলেও এর সদস্যদের রয়েছে নানা ধরনের ক্ষোভ। সেবামূলক কার্যক্রম হলেও অনেক ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের সহায়তা মেলে না বলেও অভিযোগ কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সদস্যদের। এরপরও নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এগিয়ে চলছে বিট পুলিশিং ও কমিউনিটি পুলিশিং এর কার্যক্রম।
পুলিশের সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধের তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পুলিশের পক্ষ থেকে ২০১৪ সালে চালু করা হয় কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম। প্রতিবছরের মতো এ বছরও শনিবার (৪ নভেম্বর) উদযাপিত হতে যাচ্ছে কমিউনিটি পুলিশিং ডে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘পুলিশ জনতা ঐক্য করি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ি’। দিনটি উপলক্ষে নেওয়া হয়েছে নানা ধরনের কর্মসূচি, থাকবে র্যালি, আলোচনা সভা, শ্রেষ্ঠ কমিউনিটি পুলিশিং পুরস্কারসহ নানা আয়োজন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কমিউনিটি পুলিশিং একটি গণমুখী নিবারণমূলক এবং সমস্যার সমাধানমূলক পুলিশি ব্যবস্থা। এটি জনগণকে সম্পৃক্ত করে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে জনগণের প্রত্যাশা ও মতামতের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। যদিও এ ব্যাপারে অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশি সহায়তার বিষয়গুলো মেলে না বলে অভিযোগ কমিউনিটি পুলিশের সদস্যদের।
অভিযোগ রয়েছে, মাদক, চুরি, ছিনতাইসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঠেকাতে বিভিন্ন তথ্য দিলেও অনেক ক্ষেত্রেই এসব তথ্য নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না সংশ্লিষ্ট বিট-পুলিশের কর্মকর্তাদের। এজন্য অনেক জায়গায় কমিউনিটি পুলিশিং-এর সদস্যদের সঙ্গে দূরত্ব রয়েছে বিট পুলিশের কর্মকর্তাদের।
পুলিশের সেবাকে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া, সেবা কার্যক্রমকে গতিশীল ও কার্যকর করা, সেই সঙ্গে পুলিশের সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়াতে প্রতিটি থানাকে ইউনিয়নভিত্তিক বা মেট্রোপলিটন এলাকায় ওয়ার্ডভিত্তিক এক বা একাধিক ইউনিটে ভাগ করে পরিচালিত পুলিশিং ব্যবস্থাকে বলা হয় বিট পুলিশিং। এই ব্যবস্থায় প্রতিটি বিটের দায়িত্ব পালন করা এক বা একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। প্রতিটি বিটে বিট অফিসার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে জনগণকে সম্পৃক্ত করে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমকে পরিচালিত করেন।
অনেক ক্ষেত্রেই সহায়তার জন্য তথ্য দিয়েও সহায়তা মেলে না দাবি করে উত্তরা বিমানবন্দর থানা কমিউনিটি পুলিশিং ইউনিট-২ এর সভাপতি আখতারুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বিভিন্ন বিষয়ে অবহিত করা হলে তিনি সংশ্লিষ্ট বিট পুলিশের কর্মকর্তাকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলে থাকেন। কিন্তু বিট পুলিশের কর্মকর্তারা নানা কারণে কার্যকর কোনও ব্যবস্থা নেন না। সেটা ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত সেটা বুঝি না। বিট সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সেরকম কোনও সহায়তা পাই না। এ কারণে এলাকায় মাদক, চুরি, ছিনতাই এসবের তথ্য দিলেও কার্যকর কোনও ফল মেলে না।
পুলিশ সদর দফতর বলছে, অপরাধ ও অপরাধী আমাদের বিদ্যমান সমাজ থেকেই সৃষ্টি হয়। তাই অপরাধ দমন, অপরাধীকে বিচার ও আইন আমলে আনার ক্ষেত্রে সমাজের লোকদের সহায়তা পেলে কাজটি সহজসাধ্য হয়। এছাড়া বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থা ভেদে এক অঞ্চল অন্য অঞ্চলে অপরাধের ভিন্নতা রয়েছে। আধুনিক যুগে নিত্যনতুন অপরাধের কৌশল বের হচ্ছে। এছাড়া জনসংখ্যার দিক বিবেচনা করে স্বল্প পুলিশ দিয়ে বর্তমান প্রেক্ষাপটে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ কষ্টসাধ্য।
অন্যান্য দেশ এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের পুলিশের সংখ্যা জনসংখ্যার গড় অনুপাতে অনেক কম। এজন্য পুলিশের সঙ্গে জনসাধারণের সম্পৃক্ততা থাকলে তুলনামূলক কম সংখ্যক পুলিশ দিয়েও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। তাই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও দূর করতে জনগণের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। বর্তমান কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। তাই কমিউনিটি পুলিশের বিকল্প নেই। কমিউনিটি পুলিশিং সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
পুলিশ সদর দপ্তরের জনসংযোগ বিভাগ বলছে, কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমের মাধ্যমে পুলিশের কাজে জনগণের আস্থা অংশগ্রহণ সহযোগিতা ও অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।
কারা কমিউনিটি পুলিশের সদস্য হতে পারেন
যেকোনও প্রাপ্তবয়স্ক বাংলাদেশি নাগরিক কমিউনিটি পুলিশিং-এর সদস্য হওয়ার যোগ্য। তবে বিতর্ক রয়েছে এমন ব্যক্তি, টাউট প্রকৃতির লোক, চোরাকারবারি বা অবৈধ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে যাদের, কিংবা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা নেই তাদের কোনোভাবেই কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সদস্য করা যাবে না।
কমিটির মধ্যে সব শ্রেণি, পেশা, ধর্ম, বর্ণ ও জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব থাকবে। যেহেতু কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থায় কমিউনিটির সদস্যরা স্বেচ্ছায় নিজেদের কমিউনিটিতে সৃষ্ট সমস্যাগুলো পুলিশের সহায়তায় ও অংশীদারিত্বে নিজেরাই সমাধান করে, এটি এক ধরনের সমাজসেবামূলক ও অরাজনৈতিক কার্যক্রম।
কমিউনিটি পুলিশিং-এর কী কাজ
বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশের সব জেলা রেলওয়ে হাইওয়ে, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ ও মেট্রোপলিটন ইউনিটে কমিউনিটি পুলিশিং-এর চলমান কার্যক্রমকে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে দেশব্যাপী কমিউনিটি পুলিশিং সদস্যরা কাজ করছেন। কমিউনিটি পুলিশিং এর বিভিন্ন কার্যক্রম- যেমন ওপেন হাউস ডে-এর মাধ্যমে স্থানীয় সমস্যা নিয়ে মতবিনিময় সভা, গণসচেতনতামূলক কার্যক্রম, অপরাধবিরোধী সভা, দৃশ্যমান পেট্রলিং ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড অত্যন্ত সফলভাবে কমিয়ে আনা। পুলিশের কাজে সহযোগিতা ও অপরাধ সচেতনতা তৈরিতে, বাল্যবিবাহ রোধ, ইভটিজিং প্রতিরোধ, জঙ্গিবাদ দমন, সন্ত্রাস দমন, মাদকের কুফল, নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন, যৌতুক নিরোধ, মোবাইল ফোনের অপব্যবহার ও সামাজিক মূল্যবোধ সংক্রান্তের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আলোচনা করা হয়।