রাজশাহীর বাবলাবন বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে ভাঙতে হলো তালা


, আপডেট করা হয়েছে : 14-12-2023

রাজশাহীর বাবলাবন বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে ভাঙতে হলো তালা

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসেও রাজশাহীর বাবলা বন বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধের প্রধান ফটকের তালা খেলা হয়নি। পরে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যাওয়া লোকজন প্রধান ফটকের তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকেছেন। গতবছরও তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকতে হয়েছিল।


বধ্যভূমিতে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যাওয়া লোকজন বলছেন, বুদ্ধিজীবী দিবসেও বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধের প্রধান ফটকে তালা লাগিয়ে রাখা সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি। গতবছরও একই ঘটনা ঘটেছিল। তাই এ ব্যাপারে যথাযথ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। দায়িত্বে অবহেলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানিয়েছেন তারা।


বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে নগরীর শ্রীরামপুর এলাকায় বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে যায় জাতীয় শ্রমিক লীগের জেলা শাখা ও সাবেক ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এ সময় প্রধান ফটক তালাবদ্ধ ছিল। পরে সাবেক ছাত্রনেতা কামরান হাফিজ ইয়ামিন হাতুড়ি এনে প্রধান ফটকের তালা ভাঙেন। এরপর সবাই ভেতরে ঢোকেন।


এ সময় নগর আওয়ামী লীগের সদস্য হাবিবুর রহমান বাবু, জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি আব্দুল্লাহ খান, সাধারণ সম্পাদক আবু বকর সিদ্দিক, জেলা আওয়ামী লীগের নেতা প্রভাষক শরিফুল ইসলামসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন। শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে দেখি স্মৃতিসৌধের প্রধান ফটক তালাবদ্ধ। এ সময় আমরা সিটি করপোরেশনের স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি জানাতে পারেননি যে কে এই স্মৃতিসৌধের দায়িত্বে। বাধ্য হয়ে আমাদের তালা ভাঙতে হয়েছে। গতবছরও একই ঘটনা ঘটেছিল।’


তিনি আরও বলেন, ‘বুদ্ধিজীবী দিবসে আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রদ্ধা জানাতেই এই স্মৃতিসৌধ করা হয়েছে। অথচ এটা খোলা থাকবে না তা তো হতে পারে না। কে এই স্মৃতিসৌধের দায়িত্বে, তাকেই কখনও খুঁজে পাওয়া যায় না। এটা খুব দুঃখজনক। যারা দায়িত্বে অবহেলা করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।’


মুক্তিযুদ্ধের গবেষকদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর রাজশাহীর শিক্ষক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পেশার বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এরপর তাঁদের হত্যা করে গণকবর দেওয়া হয় রাজশাহী নগরীর শ্রীরামপুর এলাকায় পদ্মা নদীর পাড়ের বাবলা বনে। বিজয়ের পর ৩০ ডিসেম্বর এই বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায়। অনেকে মনে করেন, যে ১৭ জন শহীদের মরদেহ এখানে পাওয়া যায়, তাঁদের জীবন্ত মাটিচাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। কারণ, তাঁদের একই রশিতে ফাঁস লাগানো অবস্থায় পাওয়া যায়, কিন্তু শরীরে বুলেটের বা কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না। এই স্থানটিই বাবলা বন বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত।


এই বধ্যভূমিতে যাদের মরদেহ পাওয়া যায় তাঁরা হলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মীর আব্দুল কাইয়ুম, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নাজমুল হক সরকার, সরকারি কর্মকর্তা আবদুল হক সরকার, ব্যবসায়ী আজিজুল হক চৌধুরী, শামসুল ইসলাম ঝাটু, অ্যাডভোকেট সুরেশ, বীরেন সরকার, মকবুল হক চৌধুরী, আলতাফ হোসেন, মির্জা সুলতান, মির্জা আজিজুর রহমান, নওরোজ দৌল্লাহ খান, আমিনুল হক, তৈয়ব আলী, আলাউদ্দিন চেয়ারম্যান ও মোহম্মদ মুক্তা। পরনের পোশাক ও হাতের আংটি দেখে স্বজনেরা তাদের মরদেহ শনাক্ত করেন।


এই বধ্যভূমিটি দীর্ঘ দিন অনাদরেই পড়ে ছিল। ১৯৯৫ সালের ২৫ নভেম্বর এই শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক বসানো হয়। এর উদ্বোধন করেন শহীদ মীর আব্দুল কাইয়ুমের স্ত্রী অধ্যাপক মাসতুরা খানম। সেদিন অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের জন্য এখানকার মাটি সংগ্রহ করে নিয়ে যান। ওই স্মৃতিফলক স্থাপনের পরও কেটে যায় অনেক দিন। ২০২০ সালে বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ‘মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থানসমূহ সংরক্ষণ ও মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ’ প্রকল্পের আওতায় বধ্যভূমি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। এখন জেলা প্রশাসন ও এলজিইডি এই স্মৃতিসৌধের দেখভাল করে।


রাজশাহীতে ২৫ নভেম্বর বাবলা বন গণহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেদিনও তালাবদ্ধ ছিল এই বধ্যভূমির প্রধান ফটক। গতবছরের বুদ্ধিজীবী দিবসে জনমানব উন্নয়ন সংস্থা নামের একটি সংগঠনের সদস্যরা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে স্মৃতিসৌধের প্রধান ফটকটি তালাবদ্ধ দেখেন। সেদিন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের পরামর্শে প্রধান ফটকের তালা ভেঙে ফেলা হয়। এরপর ভেতরে ঢুকে সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। পরে সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনও এই স্মৃতিসৌধে গিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।


এবারও স্মৃতিসৌধ তালাবদ্ধ থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, ‘এই স্মৃতিসৌধ এলজিইডি দেখাশোনা করে। তাদের কাছেই চাবি আছে। বুদ্ধিজীবী দিবস পালনে যে সভা হয়েছিল, সেখানে সিদ্ধান্ত হয় যে সকালে শ্রদ্ধা জানানো হবে আমার কার্যালয়ের সামনের শহীদ মিনারে। আর বিকালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে বাবলাবন স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানানো হবে। সকালে এই স্মৃতিসৌধের তালা খোলা হয়েছে কি না তা আমি জানি না।’


জানতে চাইলে এলজিইডির রাজশাহীর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহা. নাশির উদ্দিন বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধারা বিকালে বাবলাবন স্মৃতিসৌধে যাবেন বলে জানি। সে জন্য হয়ত সকালে তালা খোলা হয়নি। আমি এখনই খোঁজ নিচ্ছি। তালা খোলার ব্যবস্থা করছি।’



  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার