গত অর্থবছরে বিদেশি ঋণের সুদ বাবদ বেশি গুনতে হয়েছে ৪৪ কোটি মার্কিন ডলার, দেশীয় মুদ্রায় চার হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। মূলত ডলারের ঊর্ধ্বমুখীর কারণে টাকার অবমূল্যায়ন এবং ঋণ পরিশোধের চাপ বৃদ্ধির ফলে এটি ঘটেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩০ শতাংশের মতো। এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধের ওপর। গেল (২০২২-২৩) অর্থবছরে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে মোট ব্যয় হয় ৯৪ কোটি মার্কিন ডলার। এর আগের অর্থবছরে এ খাতে ব্যয়ের অঙ্ক ছিল ৫০ কোটি ডলার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে পাওয়া গেছে এ তথ্য।
সূত্রমতে, সুদ পরিশোধ ব্যয়ের চাপ চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরে থাকবে। অর্থবছরের শুরুতে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে যে বরাদ্দ রাখা হয়, তার চেয়ে কমপক্ষে চার হাজার কোটি টাকা বেশি গুনতে হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে কয়েকটির মধ্যে সুদ পরিশোধ ব্যয় মোকাবিলাও একটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখছে অর্থ বিভাগ। সম্প্রতি অর্থনৈতিক কো-অডিনেন্স কাউন্সিল বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনায় উঠে আসে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বিদেশি ঋণ পরিশোধে যে ব্যয় বাড়ছে, তার বড় অংশই বিনিময় হারের সমন্বয় করতে হচ্ছে বলে এটা এড়ানো সম্ভব নয়, আবার এ কারণে খুব উদ্বিগ্ন হওয়ারও কারণ নেই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যয় বৃদ্ধির প্রবণতা নিয়ে উদ্বেগের কারণ রয়েছে। বিদেশি ঋণ পরিশোধে ডলারের প্রয়োজন রয়েছে, সমস্যাটা সেখানে। কারণ ডলার কিনতে টাকার দরকার; কিন্তু সরকারের রাজস্ব আহরণে সীমাবদ্ধতার কারণে এই কাজটিও চ্যালেঞ্জিং।
অর্থ বিভাগের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয় ২৬৭ কোটি ডলার। এর আগের অর্থবছরে এ অঙ্ক ছিল ২০৮ কোটি ডলার। ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে এক বছরের ব্যবধানে বেশি গুনতে হয় ৫৯ কোটি ডলার। সেখানে আরও বলা হয়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ ও সুদ পরিশোধে বরাদ্দ ছিল ২৭৯ কোটি ডলার।
সরকার দুটি খাত থেকে ঋণ করে ব্যয় পরিচালনা করে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে বিদেশি ঋণ, অপরটি অভ্যন্তরীণ ঋণ (ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র)। ফলে বিদেশি ঋণ এবং ঋণের বিপরীতে যে সুদ আরোপিত হচ্ছে দুটোই পরিশোধ করতে হয় মার্কিন ডলারে। ফলে ডলারের মূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক লেনদেনে খরচ বাড়ছে সরকারের। কারণ ডলার কিনতে সরকারকে বেশি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে।
জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ এম কে মুজেরী শুক্রবার যুগান্তরকে জানান, বর্তমান বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। পাশাপাশি অনেক দ্বিপাক্ষিক ঋণ নেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ ঋণই দীর্ঘমেয়াদি নয়, স্বল্পমেয়াদি। অনেক ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। ফলে আগামী বছরগুলোতে বিদেশি ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ ব্যয় বাড়বে। ঋণ পরিশোধে কখনোই ব্যর্থ হয়নি সরকার। এসব ঋণের সুদ শোধ দিতে গিয়ে ব্যয় বাড়ছে। জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করা হয় ২০২২ সালের মার্চ ও এপ্রিলে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ওই সময় এক ডলারের বিনিময় দর ছিল ৮৬ টাকা। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বাড়তে থাকে এই দর। বর্তমানে যা ২৮ শতাংশ বেড়ে, ১১০ টাকায় পৌঁছেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, টাকার মান কমার ফলেই বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের খরচ বাড়ছে। তাছাড়া বৈশ্বিক নানান কারণে বাজারভিত্তিক ঋণের সুদহারও বাড়ছে। এই ডলারের মূল্য ওই বছর অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। আর এর প্রভাব গিয়ে পড়ে বৈদেশিক ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধের ক্ষেত্রে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, এসব কারণ ছাড়াও সহজ শর্তের ঋণের ছাড় কম হওয়া এবং বেশি সুদের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধির কারণেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ পরিশোধ শুরু হওয়ায় বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বেশি বাড়ছে। পাশাপাশি আছে চীন ও ভারত থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধের চাপ।
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ১১০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করেছিল বাংলাদেশ। পরের ১০ বছরে অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে ২০১ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। মূলত চীনের ঋণ পরিশোধ শুরু হওয়ায় গত দু-তিন বছর ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বাড়ছে। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে রাশিয়ার ঋণ। আর এই চাপ সামনে আরও বাড়বে। কেননা চলতি অর্থবছরেই চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প ও পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে।
এদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার মান দুর্বল হওয়ায় চলতি অর্থবছরে বিদেশি ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধে বাজেট বরাদ্দের চেয়ে সরকারের ব্যয় প্রায় ১১ শতাংশ বাড়বে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে অতিরিক্ত ৪ হাজার ২০ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে এমনটি হিসাব করা হচ্ছে। এতে চলতি অর্থবছরে সরকারের বিদেশি ঋণ পরিশোধের অঙ্ক দাঁড়াচ্ছে ৪১ হাজার ৯৬ কোটি টাকায়, অর্থাৎ আগের অর্থবছরের চেয়ে বাড়বে ৫২ শতাংশ। এর মধ্যে সুদ পরিশোধ করা হবে ১৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, বাকিটা বরাদ্দ থাকবে আসল পরিশোধে। আগের অর্থবছরে বিদেশি ঋণ পরিশোধে ২৬ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।