নির্বাচনে প্রার্থিতা বাতিলের মতো দৃশ্যমান কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কয়েকজন প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের সংঘাত-সহিংসতায় জড়িয়ে পড়া, প্রতিপক্ষকে মারধর এবং সতর্ক করার পরও আচরণ বিধিমালা বারবার লঙ্ঘন করায় এমন ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে ইসিতে আলোচনা হয়। তবে প্রার্থিতা বাতিলের আগে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হবে। দু-একদিনের মধ্যে এ বিষয়ে ইসি আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত জানাতে পারে। এর মধ্য দিয়ে অন্য প্রার্থী, তাদের সমর্থক ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ‘সতর্ক বার্তা’ দিতে চায় কমিশন। এছাড়া আরও কয়েকজন প্রার্থী ও সমর্থকের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত আসছে।
বরগুনা-১ আসনের বর্তমান সংসদ-সদস্য ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুসহ কয়েকজনকে কমিশনে তলব করা হচ্ছে। পক্ষপাতের অভিযোগে কয়েকজন ডিসি, এসপি, ইউএনও এবং ওসিকে বদলি বা প্রত্যাহার করার পরিকল্পনা রয়েছে। শনিবার ঝিনাইদহের শৈলকুপা আর হরিণাকুণ্ডের ওসিকে প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। ইসি-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে।
নির্বাচনে প্রার্থিতা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আভাস দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান। শনিবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কোনো না কোনো জায়গায়, কারও না কারও প্রার্থিতা বাতিল হবে-এটুকু আভাস দিচ্ছি। শিগগিরই জানতে পারবেন। তিনি বলেন, আজও (শনিবার) আমরা কিছু কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করেছি। এজন্য আরও কিছু তথ্য-উপাত্ত দরকার, তা চেয়েছি। ওই তথ্য পেলে কঠোর সিদ্ধান্তে চলে যাব।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, নির্বাচন কমিশন কয়েকজন সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা তৈরি করেছে। তাদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের। তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগের প্রমাণ রয়েছে। বরিশাল, খুলনা, ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও কুমিল্লা অঞ্চলের কয়েকটি আসনের প্রার্থী আছেন এ তালিকায়। ঝিনাইদহ-১, রাজশাহী-৬, কুমিল্লা-৬, মাদারীপুর-৩-সহ কিছু আসনে সহিংসতা, মারধর ও প্রতিপক্ষের প্রচারে বাধা দেওয়ার ঘটনায় তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে সংশ্লিষ্ট ডিসি-এসপিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি প্রতিবেদন ইসিতে এসেছে। এছাড়াও অন্তত ২৫ প্রার্থীর বিরুদ্ধে একাধিক দফায় আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘনের প্রতিবেদনও ইসির হাতে রয়েছে। ওইসব প্রতিবেদন ও বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে প্রার্থিতা বাতিলের মতো কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
একই দিন নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের বলেন, এখন শোকজ নয়, ডিসি-এসপিদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আমরা ব্যবস্থা নেব। কোনো একটা দৃশ্যমান আপডেট আপনারা পাবেন। তিনি বলেন, যেখানে যারা হামলা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। নির্বাচনি তদন্ত কমিটি আচরণবিধি না মানলে সংশ্লিষ্টদের শোকজ করছে। তবুও দ্বিতীয়বার একই কাজ করায় এখন ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৭টি রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে ১৯০৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ২৬৬টি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রয়েছেন। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন ৩৯১ জন। যেসব আসনে সহিংসতা হচ্ছে, এর বেশির ভাগই আওয়ামী লীগ ও একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং তাদের সমর্থকদের মধ্যে। ৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
ইসি সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনে প্রচার শুরুর পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল ও চার কমিশনার বিভিন্ন জেলায় গিয়ে প্রার্থীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। মাঠ পর্যায়ের ওই সফর থেকে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে এসেছেন কমিশনাররা। এছাড়া নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটিও তাদের প্রতিবেদন পাঠিয়েছে।
শনিবার নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান, মো. আলমগীর ও মো. আনিছুর রহমান নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতন কয়েক কর্মকর্তার সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করা হয়। সর্বশেষ মাদারীপুর-৩ আসনে সহিংসতার বিষয়ে বারবার খোঁজখবর নেন কমিশনাররা। এছাড়া একই প্রার্থীকে একাধিকবার সতর্ক করার পরও আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা কয়েক প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করে উদাহরণ সৃষ্টি করতে চান। সিইসি আজ ইসিতে এলে এ বিষয়ে আবারও বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
বেশ কয়েকটি মারধর, সহিংস ও প্রতিপক্ষকে হুমকির ঘটনায় তথ্য-উপাত্ত চাওয়া হয়েছে বলে জানান নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান। বৈঠকের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমরা আগামীকালকের (আজ) মধ্যে আরও কিছু তথ্য-উপাত্ত চেয়েছি। আজ (শনিবার) আমরা তিন নির্বাচন কমিশনার বসেছিলাম। আগামীকাল (আজ) বাকি দুজন চলে আসবেন। আগামীকাল (আজ) রিপোর্ট পাওয়ার পর আরও কিছু কঠোর সিদ্ধান্তের দিকে চলে যাব। প্রার্থিতা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে কার্পণ্য করবেন কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, না, করব না। প্রার্থিতা বাতিল হবে, কারও না কারও প্রার্থিতা বাতিল হবে বিভিন্ন জায়গায়। শুধু এটুকু আভাস আমি দিয়ে রাখলাম।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের কাছে কেউ হেভিওয়েট বা লাইট ওয়েট নয়, সবাই সমান। যিনি আইনশৃঙ্খলার বিরুদ্ধ কাজ করবেন, যিনি ভোটের বিরুদ্ধে কাজ করবেন, তার বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিতে সামন্যতম কুণ্ঠিত হব না। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশ এখন কোথাও নির্লিপ্ত নেই। প্রায় প্রত্যেকের মধ্যেই একটা কাজ করছে যে নির্বাচন কমিশন কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। আপনারা দেখেছেন অনেক পর্যাযে বদলি হয়েছে, আরও কিছু বদলি হতে পারে। এগুলো প্রক্রিয়াধীন।
ইসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, তফশিল ঘোষণার পর চার কমিশনার মাঠ পর্যায়ে সফর করেন। ওই সফরের পর সারা দেশে ইউএনও এবং ওসিদের বদলির সিদ্ধান্ত দেয় কমিশন। এবার প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আচরণ বিধিমালা প্রতিপালনে ইসির কার্যক্রম দৃশ্যমান করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, কুমিল্লা-৬ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী আ ক ম বাহাউদ্দিনের নির্দেশে গণমাধ্যমকর্মীদের সংবাদ সংগ্রহে বাধা ও লাঞ্ছিত করার বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলেছে নির্বাচন কমিশন। ওই প্রতিবেদন আজকের মধ্যে পাঠাতে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও এসপিকে বলা হয়েছে। এর আগে ঝিনাইদহ-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আব্দুল হাই ও অনুসারীদের প্রতিপক্ষকে মারধরের ঘটনায় প্রতিবেদন দিতে শুক্রবার ওই জেলার ডিসি-এসপিদের চিঠি দেয় কমিশন। একই দিন রাজশাহী-৬ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী রায়হানুল হকের ছোট ভাই মো. নাজির হোসেনকে নৌকা প্রতীকের অফিসে নিয়ে মারধর করার ঘটনার প্রতিবেদন দিতে সংশ্লিষ্টদের বলা হয়।
কাউকে ছাড় নয়-ইসি আনিছুর : মাদারীপুর-৩ আসনে সহিংসতায় হতাহতের বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, খবরটি শুনেছি। যেই সোর্স থেকে শুনেছি, সঙ্গে সঙ্গেই কিছু বিষয়ে তথ্য চেয়েছি। রিপোর্টগুলো পাওয়ার পর আমরা কঠোর সিদ্ধান্তে চলে যাব। তিনি বলেন, পিরোজপুরে এ রকম ঘটনা ঘটেছিল এবং কঠোর সিদ্ধান্তে পিরোজপুর এখন শান্ত। সেই রকম সিদ্ধান্তেই আমরা যাব। কোনো রকম কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। আমরা বড়-ছোট কোনোটাই দেখছি না। আমরা সবাইকে একই দেখছি।
তিনি বলেন, আমরা কর্মকর্তাদের চরম নিরপেক্ষতা দেখাতে বলেছি এবং কর্মকর্তা যারা দায়িত্বে আছেন, তাদের বলা হয়েছে পক্ষপাত করে কেউ রেহাই পাবে না। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ভোট করার জন্য যা যা করণীয়, আমরা করে যাচ্ছি, করে যাব।
নির্বাচন প্রতিহতে কর্মসূচিতে ইসির চ্যালেঞ্জের বিষয়ে জানতে চাইলে মো. আনিছুর রহমান বলেন, কোনো রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু অন্যকে ভোট দিতে বাধা দেওয়ার বিষয়ে এবার আইনে সংশোধনী এনেছি। অন্যকে ভোট দিতে প্রতিহত করলে সাত বছর পর্যন্ত জেল বা অর্থদণ্ড রয়েছে। পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেটসহ সবইকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলেছি। বলেছি, কোনো কার্পণ্য যেন না হয়। কাজেই কোনো ব্যত্যয় হবে না। যেখানেই প্রতিরোধ করবে, তারা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।