বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের অপ্রচলিত শ্রমবাজারের পরিসর ক্রমেই বাড়ছে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, চলতি বছর নভেম্বর পর্যন্ত অপ্রচলিত শ্রমবাজার অর্থাৎ যেসব দেশে নারী শ্রমিকরা সংখ্যায় কম যান সেখানে তাদের যাওয়ার হার কিছুটা বেড়েছে। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে গত ১১ মাসে তিন দশকের বেশি সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে রেকর্ডসংখ্যক নারী শ্রমিক কাজ করতে গেছেন। ২০২২ সালে মোট ২৮৩ জন নারী যুক্তরাজ্যে যান। কিন্তু ২০২৩ সালে এ সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৫২৯ জনে। আর এদের একটি বড় অংশ সেখানে গিয়ে কেয়ার গিভার হিসেবে কাজ করছেন।
বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, সৌদি আরব, ওমান, কাতার ও জর্ডানের মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত আগের বছরের তুলনায় কম শ্রমিক গেছেন। অন্যদিকে মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি, জাপান, হংকং, সাইপ্রাসে ২০২২ সালের চেয়ে বেশিসংখ্যক নারী শ্রমিক গেছেন। নারী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনগুলোর দেওয়া তথ্যমতে, অপ্রচলিত বাজারগুলোতে নারীদের কাজ করার পরিবেশ যেমন ভালো সেখানে তাদের মজুরিও ভালো দেওয়া হয়। নব্বই দশক থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের বাইরেও মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইউকে, ইতালি, হংকং, মরিশাসের মতো দেশগুলোতে বাংলাদেশি নারী শ্রমিকরা কাজের জন্য যাচ্ছেন। এ সংখ্যা সামান্য হলেও ধীরে ধীরে তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর মধ্যে ২০২১ সাল থেকে দক্ষিণ কোরিয়া এবং ২০২২ থেকে জাপানে নারী শ্রমিকরা যেতে শুরু করেছেন। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১ সালে মালয়েশিয়ায় ৩, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৩, ইউকেতে ৮, ইতালিতে ৭, হংকংয়ে ২৪, সাইপ্রাসে ১৪ জন নারী শ্রমিক কাজ করতে যান। এর পরের বছর ২০২২ সালে জাপানে ৪৩ কর্মী দিয়ে নারী শ্রমিকরা কাজ শুরু করেন। এ বছর মালয়েশিয়ায় ২৫, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৮, ইউকেতে ২৮৩, ইতালিতে ৬১, হংকংয়ে ৩৬, সাইপ্রাসে ২১ জন নারী শ্রমিক যান। চলতি বছর মালয়েশিয়ায় ৪৩, দক্ষিণ কোরিয়ায় ২১, ইউকেতে ৪ হাজার ৮১২, ইতালিতে ১৪৫, হংকংয়ে ১৫৯ এবং সাইপ্রাসে ৫৬ জন নারী শ্রমিক কাজ করতে যান। অর্থাৎ এসব দেশে নারী শ্রমিক যাওয়ার হার গত বছরের চেয়ে শুধু যে বেশি তাই নয়, কোনো কোনো দেশে তা কয়েকগুণ বেশি।
অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইউএই, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়ায় গত বছরের চেয়ে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত নারী শ্রমিক যাওয়ার হার বেশি। এর মধ্যে ইউএইতে এ বছর গেছেন ১ হাজার ৮৫০ জন, কুয়েতে ১ হাজার ১৬৮ জন, লেবাননে ৫৪২ জন এবং লিবিয়ায় ৪২ জন। এর বাইরে ব্রুনাই ও সিঙ্গাপুরে ২০২২ ও ২০২৩ সালে সমান সংখ্যক নারী শ্রমিক গেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অপ্রচলিত শ্রমবাজারগুলোর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন প্রদেশে কৃষি ও মৎস্য খাতে মৌসুমি শ্রমিক হিসেবে ১০০ বাংলাদেশি (চট্টগ্রামের ১১ জেলার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীভুক্ত) নারী শ্রমিক নেওয়ার কথা। বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের (বোয়েসেল) মাধ্যমে এই শ্রমিক নেওয়া হবে। তবে সৌদি আরবগামী নারী শ্রমিকদের বহির্গমন ছাড়পত্র নেওয়ার আগে ট্রেনিং সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক হওয়া, অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কর্মীদের অতিরিক্ত অভিবাসন খরচ আদায় করা এবং বিএমইটির বহির্গমন ছাড়পত্র গ্রহণের সময় কর্মকর্তাদের ‘অতিরিক্ত চাহিদা’ পূরণ করার কারণে সৌদিতে সাম্প্রতিক সময়ে নারী শ্রমিক যাওয়ার হার কমে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। আবার সৌদি আরবে ইন্দোনেশিয়া ও আফ্রিকা থেকে নারী শ্রমিক পাঠানোয় বাংলাদেশ থেকে নারী কর্মীর চাহিদা কিছুটা কমেছে। জানা যায়, স্পন্সর ভিসায় বিভিন্ন দেশ থেকে সাড়ে ৪ লাখ শ্রমিক নেবে ইতালি। ২০২৫ সালের মধ্যে এ শ্রমিক নেওয়া হবে। আর সমান সুযোগ দেওয়া হবে বাংলাদেশিদেরও। বিদেশি শ্রমিকদের নিতে নতুন করে কৃষি ও পর্যটন খাতের পাশাপাশি নার্স ও বৃদ্ধদের দেখাশোনার জন্য কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর এসব খাতে বাংলাদেশি নারীদের কাজ করার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও হংকংয়ে এখন কয়েক শ বাংলাদেশি নারী শ্রমিক কর্মরত আছেন। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশটিতে কেয়ার গিভিং খাতে বাংলাদেশি নারী কর্মীদের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যুক্তরাজ্যে এরই মধ্যে অনেক বাংলাদেশি নারী বয়স্ক ও শিশুদের সেবাদানকারী হিসেবে কাজ করছেন। নারী শ্রমিকদের যুক্তরাজ্যেও কেয়ার গিভার হিসেবে কাজের সুযোগ আছে। বিএমইটির প্রাক্কলন অনুসারে- চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে যুক্তরাজ্যে চাকরি পাওয়া প্রায় ৪৯ শতাংশ বাংলাদেশি কর্মীই নারী। বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত পাঁচ বছরে নারী শ্রমিকদের বিদেশ যাওয়ার তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় নারী শ্রমিকদের বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে শ্রমবাজারে বৈচিত্র্য এসেছে। সৌদি আরবে যে নারী শ্রমিকরা যাচ্ছেন তারা অনেকটা নিরুপায় হয়ে সেখানে যাচ্ছেন। যে নারী শ্রমিক হংকং, সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়া যাচ্ছেন তারা শিক্ষিত এবং এরা ভালো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এসব দেশে দক্ষ নারী শ্রমিকরা কাজে যাচ্ছেন। অন্যদিকে সৌদিতে যারা যাচ্ছেন তাদের কাজের দক্ষতা তুলনামূলক কম। তিনি বলেন, ইউরোপের বাজার খুলছে। নারী শ্রমিকদের জন্য এটি ভালো দিক। আমরা সরকারকে নারীদের কেয়ার গিভার করে নতুন শ্রমবাজারে পাঠানোর জন্য বলেছি।