সহসাই কাটছে না গ্যাস সংকট। মূলত এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। তবে রক্ষণাবেক্ষণ শেষে একটি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ শুরু হওয়ায় চট্টগ্রামের গ্যাস সংকট স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।
পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে আরও ২-৩ দিন লাগবে। তবে দেশজুড়ে তীব্র গ্যাস সংকট স্বাভাবিক হতে কমপক্ষে আরও ২ মাস লাগবে। কারণ মেরামতে যাওয়া দ্বিতীয় ভাসমান টার্মিনালটি সংস্কার শেষে ফিরে আসবে মার্চের প্রথম দিকে।
মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনাল আছে। দুটি থেকে দিনে ৮৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হতো। এখন একটি টার্মিনালের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৩৫ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা হচ্ছে।
মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির টার্মিনালটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গত ১ নভেম্বর বন্ধ করা হয়। দেড় মাস পর চালুর কথা থাকলেও আড়াই মাস পর গতকাল শুক্রবার রাতে চালু করা হয়। একই দিনে মহেশখালীতে চালু টার্মিনালটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। এটি আগামী মার্চে চালু করার কথা রয়েছে।
এই মুহূর্তে এলএনজি সরবরাহ প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কমে গেছে। পেট্রোবাংলার পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদ্যুৎ, শিল্প, সার গৃহস্থালি, সিএনজিসহ সাতটি সেক্টরে দৈনিক মোট চাহিদা দাঁড়াবে ৩,৭১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। বর্তমানে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাসের ঘাটতি আছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এবার শীতে গ্যাসের সরবরাহ কমার পেছনে মূল কারণ দুটি। প্রথমটি হচ্ছে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে অনুসন্ধান কমে যাওয়া। দ্বিতীয়টি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) কম আমদানি। এর ফলে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমেছে। তাই বিদ্যুৎ চাহিদা কমলেও শিল্প আর আবাসিক খাতে গ্যাস পাচ্ছেন না গ্রাহকেরা।
তাদের মতে বেসরকারি হিসাবে গ্যাসের ঘাটতি আরও বেশি, যা দেড় হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। তারা বলেছেন, দিনে দিনে উৎপাদন আরও কমে আসছে। উৎপাদন বাড়ানোর একটা চেষ্টা হয়েছিল, তাতে কিছু জায়গায় সাফল্য এসেছে। কিন্তু অন্য স্থানে কমে নেট উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে।
তাদের মতে বাংলাদেশে নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানোর কার্যকর পদক্ষেপ না থাকা এবং আমদানিনির্ভরতা বৃদ্ধির কারণেই সংকট তৈরি হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আমদানির ক্ষেত্রেও একটা স্থবিরতা আছে। এই মুহূর্তে কোনো স্বল্পকালীন সমাধান নেই। ডলারের সংকট না কাটলে জ্বালানি সংকটের তেমন উন্নতি হবে হবে না। সরকারি হিসাবে এ বছর গরমে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদা হতে পারে ১৭,৫০০ মেগাওয়াটের মতো।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেল, গ্যাস ও বিপুল পরিমাণ কয়লা প্রয়োজন হবে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমদানিসহ জ্বালানির জন্য ব্যয় হয়েছে ৬১ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলছেন, গত বছর তেল-গ্যাস-কয়লা সব মিলিয়ে ১৩-১৫ বিলিয়ন ডলার লেগেছে। এ বছর জ্বালানির দাম একই থাকলে প্রতি মাসে ১.২ বিলিয়ন ডলার লাগবে। অর্থাৎ এক বছরে ১৮ বিলিয়ন লাগতে পারে। এ বিষয়টি প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করবে।
অধ্যাপক ম তামিম আরও বলেন, বর্তমানে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করতেই সরকার হিমশিম খাচ্ছে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অনুযায়ী জ্বালানি আমদানি ব্যয় মেটানো একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম সমস্যার পেছনে প্রধানত বাংলাদেশে স্থলভাগ ও সাগরে গ্যাস অনুসন্ধান তৎপরতায় ঘাটতি দেখেন।
তিনি বলেন, সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ক্ষেত্রে ভারত ও মিয়ানমার ভালোভাবে করলেও বাংলাদেশের সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলন হয়নি, অনুসন্ধানও হয়নি। গ্যাসের সংকট সহসা কাটবে না বলে তিনি মনে করেন। দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি আমরা ওইভাবে দেখছি না। বরং মনে হচ্ছে এটা যেভাবে কমতির দিকে যাচ্ছে সেটা উঠিয়ে আনার জন্য পর্যাপ্ত অনুসন্ধান এবং কূপ খননের কাজ সেভাবে হচ্ছে না।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, জ্বালানি সংকট সমাধানের জন্য সরকার বহুমুখী জ্বালানি ব্যবহার করছে। সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে জোর তৎপরতা আছে। এ বছরই সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হবে। এছাড়া পরিবেশ ও কৃষিজমি রক্ষা করে নিজস্ব কয়লা উত্তোলনের জন্যও পদক্ষেপ নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে সরকার।
নসরুল হামিদ আরও বলেন, ‘আমাদের স্ট্রাকচার যেগুলো আছে সেগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমাদের আরও ড্রিলিং করতে হবে। তার জন্য অর্থ জোগানও দিতে হবে। অর্থটাও কিন্তু একটা বড় বিষয়। এবার ৪৬টা কূপ খনন করব দুই বছরে। আরও একশ কূপ খনন করব পঁচিশ সালের মধ্যে। তাতে আমি আশাবাদী যে দুই বছরের মধ্যে আমরা আরও ৫শ মিলিয়ন যোগ করব। কিন্তু ডিমান্ড তো আরও বেশি। দেড় হাজার এমএমসিএফ। গ্যাস অনুসন্ধান এবং জ্বালানি পরিস্থিতি নিয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয় আশ্বাস দিচ্ছে ২০২৬ সাল থেকে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ সম্ভব হবে।