ছেলে নুর আলিফের বয়স তখন দুই মাস। জন্ম নিবন্ধন করাতে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে যান শিহাব উদ্দিন। সেখান থেকে জানানো হয়, ছেলের জন্ম নিবন্ধনের আগে তার জন্ম নিবন্ধন লাগবে। চাওয়া হয় বাবা-মায়ের জন্ম সনদও।
বিপাকে পড়ে যান শিহাব উদ্দিন। শিহাব উদ্দিন বড় হয়েছেন নানার বাড়ি রাজশাহী নগরীর শিরোইল কলোনি কানার মোড় এলাকায়।
২৮ বছর বয়সী শিহাব উদ্দিন একাই খুঁজে বের করেছেন বাবার ঠিকানা। শনিবার (১৮ জুন) গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী এলাকায় বাবার সঙ্গে দেখা করেছেন তিনি। ঘণ্টাখানেক সময় কাটিয়ে ফিরে এসেছেন রাজশাহীতে। বাবার সঙ্গে কাটানো সময়টুকু হিরণ্ময়। তার দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর ভেঙেছে ঠিকই কিন্তু এখনও কিছু প্রশ্নের জবাব জানা বাকি।
১৯৯৩ সালে রাজশাহীতে আসেন গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার তিলছড়া বাজারের বাসিন্দা জাহেদুল ইসলাম। এসএসসি পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফল করতে না পারায় বকাঝকা করেছিলেন বাবা। সেই অভিমানেই ঘর ছাড়েন তিনি। রাজশাহীতে এসে নগরীর শিরোইল কলোনী এলাকায় ওঠেন। টিউশনির পাশাপাশি কাজ নেন সেখানকার একটি ওষুধ কোম্পানিতে।
ওই বছরের ৬ ডিসেম্বর বিয়ে করেন শিরোইল কলোনির কানার মোড়ের বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাকের মেয়ে সিমা খাতুনকে। ভাড়া বাসায় সংসার পাতেন তারা। সন্তান আসার সুখবর পানও। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। সন্তান জন্মের ১০ দিন আগে স্ত্রীকে বাবার বাড়িতে পাঠান। পরদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে নিরুদ্দেশ হন জাহেদুল।
সিমা খাতুনের কোল আলোকিত করে আসে শিশুপুত্র শিহাব উদ্দিন। ছেলেকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেন মা। শুরু হয় বালিকা মায়ের অন্যরকম লড়াই। বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে নেমে পড়েন জীবনযুদ্ধে। বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিকের কাজ করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন সিমা খাতুন। ছেলেকে ভর্তি করেন এলাকার হাফেজিয়া মাদ্রাসায়। শিহাব হেফজ শেষ করেন।
যে নানা বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন, বছর দুয়েক আগে তাকেও হারান শিহাব। এরপর একা হয়ে পড়েন তিনি। যে বাবাকে না পাওয়ার কষ্ট বুকে চেপে রেখেছিলেন, সেই বাবার সন্ধানে নামেন। নিজের চেষ্টায় খুঁজে বের করেন বাবার পরিচয়।
কীভাবে বাবার পরিচয় বের করলেন সেই গল্প শুনিয়েছেন শিহাব উদ্দিন। তিনি বলেন, বাবার নাম ছাড়া তার কাছে কিছুই ছিল না। নানা মারা যাওয়ার পর একবার তিনি বাবার পরিচয় জানার চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। ছেলের জন্ম নিবন্ধন আটকে যাওয়ায় আবারও বাবার পরিচয় বের করার অসম্ভব মিশনে নামেন। নানা জানিয়েছিলেন, বাবা-মায়ের বিয়ে পড়িয়েছেন পাঠানপাড়ার ল্যাংড়া কাজি।
এটুকু তথ্য নিয়েই তিনি ওই কাজী অফিসে যান। শুরুতেই বাধার মুখে পড়েন। খবর পান ওই কাজী অনেক আগেই মারা গেছেন। হাল ছাড়েননি শিহাব। খুঁজে বের করেন কাজীর এক সহকারীকে। বিয়ের কাবিননামা খোঁজার জন্য তার হাতে কিছু টাকাও দেন। দুই মাস পর জানতে পারেন তিনিও মারা গেছেন।
পরে ওই অফিসের নূর আমিন নামের একজন সহকারীকে পান শিহাব। তার কাছে ঘটনা খুলে বলেন। মাসখানেক পর তার সহায়তায় উদ্ধার হয় বাবা-মায়ের বিয়ের কাবিননামা। কাবিননামায় বাবার নাম দেওয়া ছিল জাহেদুল ইসলাম। ঠিকানা : গ্রাম- তিলছড়া, উপজেলা- কাশিয়ানী, জেলা- গোপালগঞ্জ।
বাবার ঠিকানা খুঁজতে এবার তিনি তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নেন। গুগলে তিলছড়া বাজারের দোকানপাটের সাইনবোর্ড খুঁজতে শুরু করেন। সাইনবোর্ডে থাকা ফোন নম্বরগুলো টুকে এরপর কল করেন।
অষ্টম যে নম্বরে কল করেন, রাসেল নামের সেই ব্যক্তি জাহেদুল নামের একজনের সন্ধান দেন। রাসেল জানান, জাহেদুল ইসলাম এখন গোপালপুর বাজারে থাকেন। শিহাব এবার গোপালপুর বাজারের সাইনবোর্ডের নম্বর খুঁজতে শুরু করেন।
এভাবে একজনকে তিনি পান, যিনি তার বাবা সম্পর্কে সব তথ্য দেন। বাবার নম্বর চাইতেই ওই ব্যক্তি জানান, জাহেদুল তাবলিগ জামাতে গেছেন। তার কাছে কোনো ফোন নেই। তবে তার সঙ্গী আরেকজনকে ফোন করে সবকিছু জানাবেন বলে শিহাবকে তিনি আশ্বাস দেন।
এর কয়েকদিন পর একটি অচেনা নম্বর থেকে শিহাবের কাছে কল আসে। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে একজন শিহাবের কাছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জানতে চান। শিহাব সব বলেন। তবে ওই ব্যক্তি নিজের পরিচয় দেননি। বলেন, দুই দিন পর আবার কথা বলবেন। তবে একদিন পরই ওই ব্যক্তি আবার কল করেন। শিহাব এবার তার পরিচয় জানতে একরকম চেপে ধরেন। কিছুটা সময় নিশ্চুপ থেকে ওই ব্যক্তি বলেন, তুমি যাকে পাওয়ার জন্য এত মানুষকে ফোন করেছ, আমিই সেই ব্যক্তি।
এরপর গত কয়েক মাসে ফোনে বাবা-ছেলের কথা হয়। শনিবার হঠাৎই তিনি বাবার সঙ্গে দেখা করতে কাশিয়ানী যান। ওঠেন সেখানকার একটি বাংলোতে। বাবা আসেন সেখানে। প্রথম দেখায় বাবা-ছেলে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। একে অন্যকে জড়িয়ে শিশুর মতো কেঁদে ওঠেন। তাদের এই মিলন আনন্দের, বেদনারও। এরপর ঘণ্টাখানেক একসঙ্গে সময় কাটান তারা।
শিহাব জানান, ২৮ বছর আমার বাবা ছিল না। এতিম ছিলাম। বাবাকে দেখার বড় ইচ্ছা ছিল। আজ আমার বাবা আছে। আমার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। আর কিছু চাই না। তবে বাবার কাছে আমার কিছু প্রশ্ন আছে, সেগুলোর উত্তর এখনও মেলেনি।
নানি তসলিমা বেগম জানান, যখন মেয়েকে বিয়ে দেন, তখন বয়স ১০-১২ বছর। দূরত্বের জন্য প্রথমে তারা বিয়েতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে যান। বিয়ের পর মেয়ে সন্তানসম্ভবা হয়। সন্তান জন্মের আগেই মেয়েকে রেখে জামাই নিরুদ্দেশ হয়।
বিয়ের আগে বড় ছেলে ঘর-বর দেখতে গিয়েছিল। পরে সেও আর পথঘাট চিনতে পারেনি। যে কারণে জামাইয়ের বাড়িতেও খোঁজ নেওয়া সম্ভব হয়নি। কখনও সন্তানের খোঁজও নেয়নি। ছেলে বড় হয়ে শুধু বাবার খোঁজ করত। এত দিনে তার খোঁজ পাওয়া গেল।