মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থান শহিদ কামারুজ্জামান চত্বর। এখানে ভোর থেকে জটলা বেঁধে থাকেন দিনমজুররা। এই স্থানসহ আরও কয়েকটি স্থান থেকে দিনমজুরদের দৈনিক চুক্তিভিত্তিক রাজমিস্ত্রীর কাজে নিয়ে যান অনেকে। তবে বেশ কয়েকদিন থেকে তীব্র শীতের মাঝে তারা আর কাজ পাচ্ছেন না।
পুঠিয়া উপজেলার মহেন্দ্রা গ্রাম থেকে ভোরে সাইকেল চালিয়ে এসেছেন দিনমজুর আবদুস সালাম। গত ৪ দিন তিনি কোনো কাজ পাচ্ছেন না। ভোর ছয়টায় এসে দুপুর ১২টার দিকে তিনি খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন। তার দিনের রোজগারে চলে পুরো পরিবারের খরচ।
তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন ভোরবেলায় কাজের আশায় এখানে আসছি। ফজরের আগে সাইকেল নিয়ে বের হচ্ছি। এখানে এসে ছয়টায় পৌছাচ্ছি। দুপুর পর্যন্ত বসে থেকেও কেউ কাজে নিচ্ছে না। সেভাবে কাজও পাওয়া যাচ্ছে না। ওদিকে বাড়িতে আমার আশায় সবাই বসে থাকে। একটা কাজ পেলে হয়তো বাড়িতে চুলা জ্বলবে, নাহলে জ্বলবে না।’
শুধু আবদুস সালাম নয়। তার মতো শতাধিক দিনমজুর এই শীতে কাজ পাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন। দিনমজুররা প্রতিদিন নগরীর বিভিন্ন এলাকায় কাজের জন্য বসে থেকে কাজ না পেয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরছেন। তারা বলছেন, ‘শীতের কারণে কাজ পাওয়া যাচ্ছে না। আবার এসময় জমিতেও কাজ নেই।’
রাজশাহী নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে গিয়ে দেখা যায়, মোটরসাইকেল বা যানবাহন থামলেই দিনমজুররা সেখানে ভিড় করছেন। কাজ পাওয়ার আশায় ছুটে যাচ্ছেন। কিন্তু কাজ না পাওয়ায় হতাশা নিয়ে আবার ফিরে আসছেন। নিজেদের মধ্যে আলোচনাও করছেন।
পুঠিয়ার বেলপুকুর এলাকা থেকে বাইসাইকেল চালিয়ে নগরীর কামারুজ্জামান চত্বরে এসেছেন মুনতাজ আলী। প্রায় ২০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে আসেন প্রতিদিন। তিনি জানান, শীত শুরু হওয়ার পর তারা খুবই দুর্বিসহ জীবন পার করছেন। কাজ না পেয়ে গত আটদিন বাড়ি ফিরে গেছেন।
চারঘাট উপজেলার ইউসুফপুর গ্রামের আরেক শ্রমিক লোকমান আলী বলেন, ‘দিন দিন আমাদের কাজের ক্ষেত্র কমে যাচ্ছে। রাজশাহী জুট মিল বন্ধ হওয়ায় বিপুল সংখ্যক মানুষকে বেকার হয়ে গেছে। রাজশাহী সুগার মিল বছরে মাত্র কয়েকদিন চলে। এছাড়া এ অঞ্চলে কোনো ভারি শিল্প নেই।’
পবা উপজেলার হরিয়ান এলাকা থেকে আসা হজরত আলী জানান, গত দশ বছর ধরে তিনি কাজের সন্ধানে রাজশাহী শহরে আসছেন কিন্তু আগে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হননি। গত সপ্তাহে মাত্র দুই কাজ পেয়েছিলেন।
সকাল ৮টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত দেখা যায়, প্রায় ২০০ দিনমজুরের মধ্যে মাত্র ১৬ জনকে কাজে নেওয়া হয়। বাকিরা বেলা পর্যন্ত বসে থেকে চলে যায়।
রাজশাহীতে চলতি বছর শীত নেমেছে দেরি করে। এই জানুয়ারি মাসের আগেও তেমন শীতের দাপট ছিল না। আগে জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ জুড়েই মাঝারি থেকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহের কবলে থাকতো রাজশাহী। কিন্তু গেল প্রায় ৩-৪ বছর থেকে সেই অর্থে শীত পড়েনি। চলতি বছর তাও ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে তাপমাত্রা নামল এই দু-দিন (১৩ ও ২০ জানুয়ারি)। এছাড়া দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা গড়ে ১০ ডিগ্রি থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যেই ওঠানামা করছে।
তবে এই শীতেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে রাজশাহীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। ‘সর্বনিম্ন’ তাপমাত্রা খুব নিচে না নামলেও রোদ না ওঠায় কম থাকছে ‘সর্বোচ্চ’ তাপমাত্রা। আর সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার ব্যবধান কমে আসায় হাড় কাঁপানো শীত অনুভূত হচ্ছে। প্রায় দুই সপ্তাহ থেকে বিকেলের আগে সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না। আর রোদ ওঠার কিছুক্ষণ পরই মেঘ বা কুয়াশায় তা ঢেকে যাচ্ছে। মেঘ এবং ঘন কুয়াশার মধ্যেই বইছে উত্তরের হিমেল হাওয়া।
এতে শীতার্ত মানুষগুলো যারপরনাই দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। বিশেষ করে বস্তি এলাকা, রেলওয়ে স্টেশন ও বিভিন্ন ফুটপাতের ওপর খোলা আকাশের নিচে থাকা ভাসমান মানুষগুলোর জীবন অসহনীয় এবং অবর্ণনীয় হয়ে উঠেছে। একদিকে শীতের কষ্ট; আরেক দিকে ক্ষুধার। কনকনে শীতের এই একেকটি দিন তাদের কাছে পাহাড়ের মতো হয়ে উঠেছে। শীতের হাত থেকে বাঁচতে পথের ধরে খড়কুটো, প্লাস্টিক, টায়ার ইত্যাদি জ্বালিয়ে তারা শীতের কামড় থেকে বাঁচার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এরইমধ্যে রাজশাহী জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘুরে ঘুরে কম্বল বিতরণ করা হচ্ছে।
রাজশাহী জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ নিজে ঘুরে ঘুরে ছিন্নমূল শীতার্ত মানুষগুলোর মধ্যে কম্বল বিতরণ করছেন। এখনও কম্বল বিতরণ কর্মসূচি অব্যাহত আছে। এরই মধ্যে রাজশাহী জেলায় ৬৪ হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন, রাজশাহী জেলা প্রশাসক।
অন্যদিকে শীত বাড়ায় রাজশাহীতে ঠাণ্ডাজনিত নানা রোগের প্রাদুর্ভাবও বেড়েছে। আর আক্রান্তদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধদের সংখ্যাই বেশি। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে বর্তমানে নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়াসহ শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বছরের স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দুই-তিনগুণ বেড়েছে। প্রতিদিন সকাল থেকেই রামেক হাসপাতাল, উপজেলা হাসপাতাল ও বেসরকারি ক্লিনিকে রোগীরা চিকিৎসার জন্য ভিড় করছেন।
শীত বাড়ায় শিশু ও বয়স্কদের প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না করার পরামর্শ দিয়ে রামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক (ইএমও) ডা. বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘এ সময়ে যে কেউ ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। এসব রোগ থেকে রেহাই পেতে গরম কাপড় ব্যবহার, যতটা সম্ভব ঠাণ্ডা পরিবেশ এড়িয়ে চলা জরুরি। শিশুদের ঠাণ্ডা বাতাস থেকে দূরে রাখা, সেইসঙ্গে ধুলোবালি থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখতে হবে। শৈত্যপ্রবাহ চলাকালে শিশুদের ঘর থেকে কম বের করতে হবে। ঘরের মধ্যে ঠাণ্ডা বাতাস যেন না ঢোকে, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে অভিভাবকদের।’
রাজশাহী জেলা সিভিল সার্জন ডা. আবু সাইদ মোহাম্মদ ফারুক বলেন, ‘রাজশাহীর উপজেলা পর্যায়ে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। আর ভর্তি রোগীর চেয়ে বহির্বিভাগে রোগীর সংখ্যাই এখন বেশি। তবে পরিস্থিতি যে খুব খারাপ, এমনটা নয়। প্রতি বছরই শীতের সময় রোগী বাড়ে। তাই তাদের সেরকম ব্যবস্থাপনাও থাকে, এবারও আছে।’
রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ইনচার্জ) রহিদুল ইসলাম বলেন, ‘জানুয়ারি মাস শুরুর পর থেকে প্রায় বেশিরভাগ সময়ই দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কম থাকছে। আকাশে রোদ না ওঠায় মেঘমেদুর ও কুয়াশাচ্ছন্নই থাকছে রাজশাহীর আবহাওয়া। আর এর কারণে শৈত্যপ্রবাহ না থাকলেও দীর্ঘসময় ধরে তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে।’