ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণের নামে অভিনব কায়দায় চলছে প্রতারণা। একটি সংঘবদ্ধ চক্র নগরীর উত্তরায় ‘আপস্পট একাডেমি’ নামে নামসর্বস্ব একটি অফিস খুলে বসে বেশ কিছুদিন আগে। তারা সিপিএ মার্কেটিং ফ্রিতে শেখানোর কথা বলে দুই বছরে নানা কৌশলে ৪৭ হাজার তরুণ-তরুণীর কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ১২ কোটি টাকা। এছাড়াও অন্যান্য প্রশিক্ষণের বাহানায় বিভিন্ন তরুণ-তরুণীর কাছ থেকে টাকাপয়সা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, চক্রটি কোর্স ফি ছাড়া ফ্রিল্যান্সিং শেখানোর বিজ্ঞাপন দেয় তাদের ফেসবুক পেজে। উল্লেখ করা হয়, এ কোর্স করলে সিপিএ মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে ঘরে বসে প্রতিদিন ১০ থেকে ৪০ ডলার আয় করা যাবে। আগ্রহীদের রেজিস্ট্রেশন করার একটি লিংক থাকে ওই বিজ্ঞাপনে। প্রতি ব্যাচে ৩০০ জন করে প্রশিক্ষণার্থী নেওয়া হয়। ঘরে বসে আয়ের এই অফারে আগ্রহীরা অংশ নেন প্রশিক্ষণে। জুম অ্যাপের মাধ্যমে নির্ধারিত দিনে ক্লাস শুরু হয়। এরপর থেকে চলতে থাকে ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে মোটিভেশনাল কথাবার্তা। এরপর অনলাইনে কাজ করার জন্য প্রিমিয়াম সফটওয়্যার সংগ্রহ করার কথা জানানো হয়। বলা হয়, ওই সফটওয়্যার সংগ্রহ না করলে আয় করা সম্ভব নয়। এরপর একপ্রকার বাধ্য করেই প্রিমিয়াম সফটওয়্যার দেওয়ার নামে প্রশিক্ষণার্থীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় জনপ্রতি আড়াই হাজার টাকা করে। আর বিনিময়ে সরবরাহ করা হতো ফ্রি সফটওয়্যার, যা দিয়ে প্রশিক্ষণার্থীরা কাজ করতে পারতেন না।
পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের (এটিইউ) একটি সূত্র জানিয়েছে, চক্রটি প্রতি ব্যাচের প্রশিক্ষণার্থীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিত সাড়ে ৭ লাখ টাকা। এভাবে ২ বছরে চক্রটি ১৫৬টি ব্যাচে অংশ নেওয়া তরুণ-তরুণীদের কাছ থেকে প্রায় ১২ কোটি টাকা হাতিয়েছে।
সম্প্রতি রহিম মন্ডল নামে একজন ভুক্তভোগী এটিইউ সদর দপ্তরে অভিযোগ করেন। এটিইউ-এর পক্ষ থেকে তাকে থানায় মামলা করার পরামর্শ দেওয়া হয়। তিনি ১৮ জানুয়ারি আশুলিয়া থানায় মামলা করেন আপস্পট একাডেমির সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে এবং গোয়েন্দা নজরদারি চালিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ৬ প্রতারককে মঙ্গলবার রাতে উত্তরায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করে এটিইউ। গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন শামীম আহমেদ, জাহিদুল ইসলাম, মাহিদুল হক মাহাদি, আশরাফুল ইসলাম, এহসান মাশফী ও রনি সরদার।
এটিইউ-এর সহকারী পুলিশ সুপার ওয়াহিদা পারভীন জানান, তারা দীর্ঘদিন ধরে কোর্স করানোর নামে অসংখ্য তরুণ-তরুণীর কাছ থেকে নানা বাহানায় কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। অনলাইন ক্লাসে তারা অল্প সময়েই সিপিএ মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা ইনকাম করার বিভিন্ন ধরনের লোভনীয় অফারের বিষয়ে বলতে থাকে। পরে সিপিএ মার্কেটিংয়ের জন্য বিভিন্ন প্রিমিয়াম রাশিয়ান সফটওয়্যার টুলস প্লাগইন করার কথা বলে বিকাশের মাধ্যমে আড়াই হাজার টাকা করে চায়। টাকা পরিশোধ করলে পরবর্তী ক্লাসে এনরোল করা হবে বলে বলা হয়। আগ্রহী প্রশিক্ষণার্থীরা টাকা পরিশোধ করলে তাদের সিপিএ মার্কেটিংয়ের ওপর দায়সারাভাবে কিছু রেকর্ডেড ও কিছু লাইভ ক্লাস করানো হয়।
তাছাড়া যেসব প্রিমিয়াম টুলসের কথা বলে তারা বিকাশে টাকা নেয়, সেগুলো দেওয়া হতো না। প্রিমিয়াম সফটওয়্যার টুলসের নামে তারা কিছু ফ্রি সফটওয়্যার সরবরাহ করে, যা দিয়ে অংশগ্রহণকারীরা আয় করতে সক্ষম হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু ভুক্তভোগী অনলাইনে কিছু ডলার আয় করতে পারলেও ওয়েবসাইট আপডেটের কথা বলে অর্জিত ডলার কেটে রাখা হতো। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভুক্তভোগী যুগান্তরকে বলেন, কেউ আংশিক পেমেন্ট করলে তাকে অনলাইন ক্লাস থেকে ব্লক করে দেওয়া হতো। ফেরত দেওয়া হতো না তার টাকা। এভাবেও তারা হাতিয়ে নিয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ।
ভুক্তভোগীরা জানান, কোর্স সমাপ্ত হওয়ার পর সিপিএ মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে আপস্পট একাডেমি সহযোগিতা করার কথা বলত। কিন্তু বাস্তবে কোনো ধরনের সেবা মেলে না। মেসেজ বা হটলাইনে আপস্পট অ্যাকাডেমির সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। মূলত তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো টাকা হাতিয়ে নেওয়া। প্রতারিত হওয়া ভুক্তভোগীদের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ রয়েছে। এতে হাজারের বেশি সদস্য রয়েছেন।
আপস্পট একাডেমির ফেসবুক পেজ ভিজিট করে দেখা গেছে, চমকপ্রদ নানা ধরনের পোস্ট রয়েছে পেজটিতে। বিভিন্ন নাম ব্যবহার করে দেখানো হয়েছে এক মাসে কে কত টাকা আয় করল। শুধু তাই নয়, সফল ফ্রিল্যান্সারদের নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন টেলিভিশনে করা প্রতিবেদনের ভিডিও আপলোড করা আছে তাদের পেজে।
এ ব্যাপারে তদন্তসংশ্লিষ্টরা যুগান্তরকে জানিয়েছেন, তরুণ-তরুণীদের আকর্ষণের জন্য আপস্পট একাডেমির সংশ্লিষ্টরা তাদের পেজে ভুয়া লাইক, কমেন্ট এবং রিভিউ ব্যবহার করেছে।