গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে প্লট ও ফ্ল্যাট ভাগাভাগিতে ‘সচিব-চেয়ারম্যান’ কোটা


, আপডেট করা হয়েছে : 30-01-2024

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে প্লট ও ফ্ল্যাট ভাগাভাগিতে ‘সচিব-চেয়ারম্যান’ কোটা

নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষে। সরকারি প্লট ও ফ্ল্যাট বরাদ্দে শীর্ষ কর্মকর্তারা নিজেরাই নিজেদের নামে কোটা চালু করেছেন সেখানে। নাম দেওয়া হয়েছে ‘সচিব কোটা’ ও ‘চেয়ারম্যান কোটা’। এসব কোটায় গত কয়েক মাসে অর্ধশত প্লট-ফ্ল্যাট বিলি-বণ্টনও হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন খোদ পূর্ত মন্ত্রণালয় ও জাগৃকের কর্মকর্তারা। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, এ ধরনের কোটা চালু করার আইনগত কোনো ভিত্তি নেই।


রাজধানীসহ সারা দেশে সরকারিভাবে মানুষের আবাসনব্যবস্থা নিশ্চিতে কাজ করে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্লট ও ফ্ল্যাট প্রকল্প বাস্তবায়ন করে থাকে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ (জাগৃক), রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ (রাজউক) কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। সেসব প্রকল্পে প্লট বা ফ্ল্যাট বরাদ্দের ক্ষেত্রে আইনসিদ্ধভাবে কোটা নির্দিষ্ট করা আছে। সরকারের পক্ষে মন্ত্রী এসব কোটা সংরক্ষণ করেন। যুগের পর যুগ ধরে এভাবেই চলে আসছে। কিন্তু এবারই প্রথম এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে ‘সচিব কোটা’ ও ‘চেয়ারম্যান কোটা’ চালু করল জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ।


জানতে চাইলে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আগে কোনো কোটা ছিল কি না, আমার জানা নেই। তবে সচিব মহোদয়ের কোটা ও চেয়ারম্যানের কোটা কর্তৃপক্ষের প্রসপেকটাসে উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। তাই এসব কোটায় প্লট বা ফ্ল্যাট বরাদ্দ দিতে আইনি জটিলতা থাকার কথা না।’ 


মিরপুরের ৯ নম্বর সেকশনে ১ হাজার ৫৬০টি আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ (স্বপ্ন নগর-২) প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে জাগৃক। নতুন চালু হওয়া কোটায় ওই প্রকল্পে ছয়টি ফ্ল্যাট বরাদ্দের তথ্য এসেছে আজকের পত্রিকার হাতে। অনুসন্ধানে জানা যায়, স্বপ্ন নগর-২ প্রকল্পে অবিক্রীত অবস্থায় কিছু ফ্ল্যাট ছিল। একজন প্রকৌশলীর সহযোগিতায় বরাদ্দ না হওয়া এসব ফ্ল্যাটের তথ্য পান গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন। উত্তরা থেকে মিরপুর হয়ে মতিঝিলে মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর হঠাৎ করেই এসব ফ্ল্যাটের দাম ও চাহিদা বেড়ে যায় বহুগুণ। এই অবস্থায় কোটা চালু করে ছয়জনকে ৬টি ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয় প্রকল্পটিতে। বরাদ্দ করা ওই ছয় ফ্ল্যাটের মধ্যে চারটির আয়তন ১ হাজার ৫৪৫ বর্গফুট। ফ্ল্যাট নম্বর ২৫/এফ-১, ২৫/এইচ-৫, ২৫/ডি-৬ এবং ২৫/সি-১২। ফ্ল্যাটগুলো বরাদ্দ পান যথাক্রমে মোহাম্মদ আবুল কালাম, মো. মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, মো. খায়রুল কবির অন্তু এবং কাজী হাবিবুল্লাহ নামের চার ব্যক্তি। বাকি দুটি ফ্ল্যাট ১ হাজার ৩৩৮ বর্গফুট আয়তনের। ১৬/ই-৪ এবং ১৩/ডি-১০ নম্বরের এই ফ্ল্যাট দুটি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে নূর মোহাম্মদ শেখ ও দিলারা পারভীনের নামে। 


নথি ঘেঁটে জানা যায়, চলতি জানুয়ারি মাসের ১১ তারিখ জাগৃকের নির্বাহী প্রকৌশলী (ঢাকা ডিভিশন-১) জোয়ারদার তাবেদুন নবীর স্বাক্ষর করা চিঠিতে এই ছয়টি ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর আগে জাগৃকের উপপরিচালক আর. এম. সেলিম শাহনেওয়াজ এ প্রকৌশলীর কাছে একটি চিঠি দেন। গত বছরের ১২ নভেম্বর লেখা এ চিঠিতে তিনি ওই প্রকল্প থেকে ‘সচিব মহোদয়ের সংরক্ষিত কোটা’য় বরাদ্দের একটি সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন।


জানতে চাইলে গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিব আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সামান্য পরিমাণ কোটা রাখা হয়েছে বঞ্চিত মানুষের জন্য। এখানে মুক্তিযোদ্ধা ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যাঁরা এ সুবিধা পাচ্ছেন না, তাঁদের জন্য মূলত সচিব হিসেবে এ কোটা রেখে সহায়তা করার চেষ্টা করছি। এখানে কোনো ধরনের নেতিবাচক চিন্তা থেকে কোটা সংরক্ষণ করা হয়নি।’


অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, জাগৃকের ২৪৪তম বোর্ড সভা থেকে মূলত চেয়ারম্যানের নামে কোটা চালু করার সিদ্ধান্ত হয়। সেখানে ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলায় সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস আবাসিক প্লট উন্নয়ন প্রকল্পের মোট ৯৮টি প্লটের মধ্যে ৭টি ‘চেয়ারম্যান কোটায় সংরক্ষণ’ করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। এগুলোর মধ্যে জসিম উদ্দিনকে পাঁচ কাঠা আয়তনের একটি এবং মো. মুরশীদ আবেদীন, মো. মামুনুর রশিদ, মো. রেজাউল করিম হাওলাদার, মো. জসিম উদ্দিন, মো. নূরুল ইসলাম বিশ্বাসকে তিন কাঠা আয়তনের একটি করে প্লট দেওয়া হয়। এরপর কর্তৃপক্ষের ২৪৯তম বোর্ড সভায় যশোর হাউজিং এস্টেটে আবাসিক প্লট বরাদ্দ প্রকল্পে সচিব ও চেয়ারম্যানের জন্য পৃথকভাবে ৩০ শতাংশ হারে প্লট সংরক্ষণ করার সিদ্ধান্ত হয়। সেখান থেকে এরই মধ্যে সচিবের কোটায় রাফসান ছরওয়ার ও মো. হারুন অর রশীদ নামের দুই ব্যক্তিকে ২টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ গত ৬ ডিসেম্বর জাগৃকের ২৫০তম বোর্ড সভায় বরিশালের রূপাতলী হাউজিং এস্টেটের আবাসিক প্লট প্রকল্প থেকে চেয়ারম্যানের সংরক্ষিত কোটায় কাজী শফিউল ইসলাম নামের একজনকে তিন কাঠা আয়তনের একটি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। 


এমন কোটা চালু হওয়ার পর জাগৃকের চেয়ারম্যান খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান নিজেই এ সুবিধা নিতে একটি আবেদন করেন বলে জাগৃকের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তিনি নিজ নামে রাজধানীর সাতমসজিদ রোডের দোলনচাঁপায় ১ হাজার ৬০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের আবেদন সর্বশেষ বোর্ড সভায় উত্থাপন করলে একাধিক বোর্ড সদস্য বিব্রত হন। একপর্যায়ে বোর্ডের সদস্য হিসেবে আসা পূর্ত মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব বিষয়টি আরও বুঝেশুনে পরে উত্থাপনের পরামর্শ দেন। এরপর তিনি এই আবেদন আর দাপ্তরিক প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করেননি।


জাগৃকের বরাদ্দ নীতিমালার ৪ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি এবং প্রসপেকটাস প্রকাশ ব্যতীত কোন প্লট বা ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া যাবে না।’ আবার অনুচ্ছেদ ৪(৪)-এ বলা আছে, জাগৃকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ৫ ভাগ এবং পূর্ত মন্ত্রণালয়ের জন্য ২ দশমিক ৫ ভাগ কোটা সংরক্ষণ করা যাবে।’ এর বাইরে কোনো কোটা সংরক্ষণের আইনগত সুযোগ নেই। তারপরও সচিব ও চেয়ারম্যানের নামে কীভাবে কোটা হয়, তা বোধগম্য নয় সংশ্লিষ্ট অনেকেরই।


জাগৃকে চার বছরের বেশি সময় চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব খন্দকার আখতারুজ্জামান। আজকের পত্রিকার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের সব ধরনের বরাদ্দের বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা আছে। সেখানে আসলে সরকার বা মন্ত্রীর কোটার বাইরে আমরা কখনো অন্য কোনো পদের বিপরীতে কোটা চালু হতে দেখিনি। অন্য কোনোভাবে কোটা চালু করার সুযোগও নেই। এখন কীভাবে তা চালু হলো, তা বলতে পারছি না।’


একই কথা বলেন পূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করা একজন সাবেক মন্ত্রী। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘প্লট বা ফ্ল্যাট বরাদ্দের বিষয়টি মূলত একটি আইন দ্বারা সরকারকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষে মন্ত্রী এটি সাধারণত নির্ধারণ করে থাকেন। এখন যদি কোনো কর্মকর্তা তাঁর নামে আইন পরিবর্তন না করে এমন সংরক্ষিত কোটা চালু করেন, তবে তা আইনসিদ্ধ হবে না।’


বিষয়টি নিয়ে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘এ ধরনের কোটা সরকারের পক্ষে জনপ্রতিনিধি হিসেবে মন্ত্রী মূলত সংরক্ষণ করেন। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা তা বাস্তবায়ন করে থাকেন। এখানে আইনকানুন না মেনে নিজেদের ইচ্ছামাফিক কোটা চালু করা প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালা পরিপন্থী। এতে মূলত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা প্রকাশ পায়।’



  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার