ব্যস্ত সড়কে যানজট বাড়াচ্ছে ক্যানসার ঝুঁকি


, আপডেট করা হয়েছে : 31-01-2024

ব্যস্ত সড়কে যানজট বাড়াচ্ছে ক্যানসার ঝুঁকি

রাজধানীর যানজটপূর্ণ ব্যস্ত সাতটি সড়ক বাড়াচ্ছে ক্যানসারের ঝুঁকি। এসব সড়কে জটে আটকেপড়া যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়ায় রয়েছে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার উপাদান, যা শ^াসের সাথে মানবদেহে প্রবেশ করছে। ফলে ঝুঁকি বাড়ছে ফুসফুসসহ অন্যান্য ক্যানসারের। বাংলাদেশ শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে যে সাতটি এলাকার সড়ককে চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে- মতিঝিল, প্রেসক্লাব, শাহবাগ, ফার্মগেট, এলিফ্যান্ট রোড, টিএসসি ও গাবতলী।


‘ঢাকায় যানবাহনের নির্গত ধোঁয়ায় মিশ্রিত পলিসাইক্লিক এরোমেটিক হাইড্রোকার্বনের বিস্তার এবং বিভিন্ন বয়সীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও এর প্রতিকার’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদনটি আন্তর্জাতিক সাময়িকী স্প্রিংগার ন্যাচারের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশ হয়েছে। এ বিষয়ে গতকাল কথা হয় ওই গবেষক দলের প্রধান ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি আমাদের সময়কে জানান, দীর্ঘমেয়াদি শ^াসযন্ত্রের ক্যানসারে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন এসব সড়কে নিয়মিত চলাচলকারী প্রাপ্তবয়স্করা।


গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাজধানীতে ৪৬-৬৪ শতাংশ পলিসাইক্লিক এরোমেটিক হাইড্রোকার্বন (অপরিশোধিত তেল পুড়ে তৈরি হওয়া রাসায়নিক) নির্গত হয় যানবাহনের ধোঁয়া থেকে। বিশেষ করে ফিটনেসবিহীন যানবাহন থেকে এ ধরনের রাসায়নিক বেশি নির্গত হয়। এ ধোঁয়ায় রয়েছে উচ্চমাত্রার ক্ষতিকর কার্সিনোজেনিক (ক্যানসার সৃষ্টিকারী) বেনজো এ পাইরিন। বেনজো এ পাইরিনযুক্ত এ ধোঁয়া দীর্ঘদিন গ্রহণের ফলে মানব শরীরের ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত, পরিবর্তিত হয় এবং শ^াসযন্ত্রের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে।


ড. মনিরুজ্জামান বলেন, যানজটের কারণে রাজধানীর বায়ুতে দূষণকারী কণার সংখ্যা বাড়ছে। আমরা রাজধানীর সাতটি সবচেয়ে ব্যস্ত সড়ক থেকে ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ৮৪টি নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণাটি করেছি। শীত এবং বর্ষা দুই সিজনেই নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। স্যাম্পলগুলো আমরা দেশের মানুষের গড় উচ্চতা (৫-৬ ফিট) অনুযায়ী খোলা জায়গায় রেখেছি। গবেষণায় আমরা সদ্যোজাত শিশু (০-১ বছর), হাঁটতে শেখা শিশু (১-৬ বছর), কিশোর (১২-১৮ বছর) ও প্রাপ্তবয়স্কদের (১৮-৭০ বছর) স্বাস্থ্যঝুঁকির পরিমাণ পৃথকভাবে নির্ণয় করেছি।


গবেষণার ফল থেকে জানা যায়, রাজধানীর সাতটি সড়কের বায়ুতে ধাতু এবং উচ্চমাত্রার ক্যানসার সৃষ্টিকারী বেনজো এ পাইরিনের মতো পলিসাইক্লিক এরোমেটিক হাইড্রোকার্বনের। রাজধানীর ব্যস্ততম এসব সড়কে বেনজো এ পাইরিনের গড় পরিমাণ ৩১-১৪৫ এনজি/মি৩। যেখানে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত স্বাভাবিক মাত্রা ১ এনজি/মি৩।


গবেষকরা বলছেন, এ গ্যাস দ্বারা দূষিত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে থাকলে এসব গ্যাস রক্তে মিশে যায় এবং ফুসফুসের স্থায়ী ক্ষতি করে। ফুসফুসের রোগ যেমন হাঁপানি, ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ, ইন্টারস্টিসিয়াল লাঙ ডিজিজের প্রবণতা বেড়ে যায়। যা শ^াস প্রশ^াসের সাথে দীর্ঘদিন ধরে প্রবেশ করতে থাকলে শ^াসযন্ত্রে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে।


গবেষণা প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যিনি শীতে প্রতিনিয়ত এসব সড়কে যাতায়াত করেন তিনি দৈনিক গড়ে ৯.৭০-১১.২ মাইক্রোগ্রাম বেনজো এ পাইরিনের মতো পলিসাইক্লিক এরোমেটিক হাইড্রোকার্বন গ্রহণ করছেন। শীতকালে এই শোষণের মাত্রা ২.৩-২.৭ গুণ বেড়ে যায়। যার ১.২২ মিউগ্রাম সরাসরি পিএম ২.৫ শোষণের মাধ্যমে ব্যক্তির এ্যালভিওলাইয়ে (ফুসফুসের ছোট থলি) জমা হচ্ছে। যা পরে রক্ত সরবরাহের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গে।


যানবাহন ঘটিত এমন স্বাস্থ্য সমস্যাকে উদ্বেগের বলছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, গবেষণায় পাওয়া সমস্যাগুলো সমাধানের জন্যও গবেষণার উদ্বোগ নিতে হবে আর যানবাহনগুলোকে আনতে হবে বিশেষ মনিটরিংয়ের আওতায়।


এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, যানবাহনের নির্গত ধোঁয়ায় বায়ুদূষণ এবং ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বর্তমানে খুবই উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি মনে করি, এ সংকট নিরসনে যানবাহনের ফিটনেস চেক করা এবং নিয়মিত মনিটরিংয়ে জোর দিতে হবে। যেসব যানবাহন অতিরিক্ত দূষণের কারণ, সেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে সড়ক থেকে সরিয়ে দিতে হবে। এই জনস্বাস্থ্যবিদ মনে করেন, দেশের জনগণের সুস্বাস্থ্যই উন্নয়নের অপরিহার্য শর্ত।


উল্লেখ্য, গত কয়েক দশকে নগরায়নের ফলে ঢাকা শহরে বায়ুদূষণঘটিত পরিবেশগত পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে যানযট রাজধানী ঢাকার অন্যতম প্রধান একটি সমস্যা। ২০২১ সালে গ্লোবাল লাইভিবিলিটি ইনডেক্সের করা তালিকায় সবচেয়ে কম বসবাসযোগ্য শহর হিসেবে ৪ নম্বরে ছিল ঢাকা। যানজট বৃদ্ধির কারণে বায়ুর খারাপ মান এর অন্যতম কারণ।



  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার