সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছে বিএনপি। এতে দলটির বহু নেতাকর্মী মামলা-হামলায় জর্জরিত। ২৮ অক্টোবরের পর গ্রেফতারের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২৫ হাজার। বিএনপি মহাসচিবসহ দলটির কেন্দ্রীয় নেতারাও দীর্ঘদিন ধরে কারাবন্দি। গত তিন মাসে বন্দি অবস্থায় অসুস্থ হয়ে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় বন্দিদের স্বজনদের মধ্যে নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে কারাগারে অসুস্থ ও বয়স্ক নেতাদের নিয়ে চিন্তিত পরিবারের সদস্যরা। বন্দিদের জামিনে দৌড়ঝাপ করছেন তারা। কিন্তু শুনানিতে আটকে আছে অনেকের জামিন। বিএনপি ও বন্দি নেতাদের স্বজনের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘সারা দেশের কারাগারগুলোতে বিএনপির নেতাকর্মীরা মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছেন। কেউ যেন টু-শব্দও না করতে পারে সেজন্য কারাগারের ভেতরে-বাইরে চলছে বিরোধী দলের সক্রিয় নেতাকর্মীদের ওপর নানাবিধ অমানবিক আচরণ। কারাগারে তারা অসুস্থ হচ্ছেন এবং ধুঁকে ধুঁকে সেখানে মরছেন।’
বিএনপি ও কারাবন্দি নেতার স্বজনদের অভিযোগ, গ্রেফতারের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনসহ নানা রোগের কারণে নেতাকর্মীরা অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাদেরকে কারাগারে পাঠানো হলেও সেখানে সঠিক চিকিৎসা না হওয়ায় অনেকের মৃত্যু হয়েছে। দলটির নেতারা জানান, গত বছরের আগস্ট থেকে সারা দেশে কারাগারে ১২ বিএনপি নেতার মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে ২৮ অক্টোবরের পর মৃত্যু হয় ৯ জনের। যাদেরকে ঢাকায় মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাদের অনেকের বয়স চল্লিশ থেকে সত্তোরোর্ধ।
প্রায় অভিন্ন তথ্য দিয়ে কারাবন্দি নেতাদের পবিরারের সদস্যরা জানান, ওই মহাসমাবেশের পর দলটির অসংখ্য শীর্ষ নেতা কারাগারে আছেন। যাদের অনেকেরই বয়স সত্তোরোর্ধ। সিনিয়র ও কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে অনেকেই অসুস্থতায় ভুগছেন। এরমধ্যে কারাগারের বন্দি জীবনে বিভিন্ন রোগে কাবু হয়ে পড়ছেন তারা। উচ্চ রক্তচাপ, আইবিএস, মেরুদণ্ড, দাঁতের সমস্যাসহ বেশ কয়েকটি রোগে আক্রান্ত বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ২৬ জানুয়ারি মহাসচিবের সঙ্গে কারাগারে সাক্ষাৎ করে তার সহধর্মিণী রাহাত আরা বেগম জানিয়েছেন, গ্রেফতারের দেড় মাস আগে সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন তারা। ফখরুলের শরীর ভালো নেই। ওজন কমে গেছে।
কারাবন্দি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীও গুরুতর অসুস্থ। আমীর খসরুর পরিবারের এক সদস্য বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই তিনি অসুস্থ। গ্রেফতারের আগে নিয়মিত চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধায়নে ছিলেন। কারাগারে যাওয়ার পর তিনি আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’
বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, হাবিবুর রহমান হাবীব, আতাউর রহমান ঢালী, যুগ্ম মহাসচিব মজিবুর রহমান সারোয়ার বয়সের ভারে নানা রোগে আক্রান্ত। যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল কিডনি রোগ ছাড়াও মেরুদণ্ডে গুলির চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন।
এদিকে শারীরিকভাবে অসুস্থ সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স। তিনি ডায়াবেটিক, হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। এছাড়া বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীর ওপেন হার্ট সার্জারি করা হয়েছে। এর বাইরেও ডায়াবেটিক, চোখের সমস্যা রয়েছে। গত বছরের ২৩ মে থেকে কারাগারে আছেন নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম রবি। তিনি হৃদরোগ, লিভার, শ্বাসকষ্টসহ আরও বেশ কিছু রোগে আক্রান্ত বলে জানিয়েছে পরিবার। দলীয়ভাবে জানানো হয়, বিএনপি নেতা হাবিবুল ইসলাম হাবিব, ঢাকা মহানগর উত্তরের আমিনুল হক, দক্ষিণের রফিকুল আলম মজনু, সাইফুল আলম নীরব, এসএম জাহাঙ্গীর, গোলাম মাওলা শাহীন, আজিজুর রহমান মুসাব্বিরসহ অনেকে কারাগারে গুরত্বর অসুস্থ।
আমিনুল হকের পরিবারের সদস্যরা জানান, তার কিডনিতে পাথর শনাক্ত হয়েছে। এজন্য উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। কারাগারে থাকায় যথাযথ চিকিৎসা হচ্ছে না। সরকার জামিনও দিচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে পরিবারের সদস্যদের শঙ্কায় দিন কাটাছে। মজনুর পরিবারের সদস্যরা জানান, কয়েক মাস আগে তার পিত্তথলিতে অপারেশন হয়েছে। এখন সেখানে ইনফেকশন (সংক্রমণ) দেখা দিয়েছে। কারাগারে খুবই কষ্টে দিনযাপন করছেন। মামলার শুনানি হলেও জামিন মিলছে না।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ডের পর সারা দেশে দলটির অসংখ্য নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়। এ সময়ে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা কারাবন্দি অবস্থায় মারা যান। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান কেউ কেউ। ২৫ নভেম্বর কারাবন্ধি অবস্থায় মারা যান চট্টগ্রামের বিএনপি নেতা গোলাপুর রহমান। ৩০ নভেম্বর মারা যান ঢাকা ওয়ারি এলাকার ইমতিয়াজ হাসান বুলবুল। ১ ডিসেম্বর মারা যান গাজীপুরের শ্রীপুরের আসাদুজ্জামান খান হিরা। ৭ ডিসেম্বর মারা যান নাটোর সিংড়ার আবুল কালাম আজাদ। ১১ ডিসেম্বর রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে মারা যান মনিরুল ইসলাম। ২০ ডিসেম্বর নওগাঁর মতিবুল মণ্ডল কারাবন্দি অবস্থায় মারা যান। ২৮ ডিসেম্বর কাশিমপুর কারাগারে মারা যান ঢাকা মুগদার শ্রমিক দলের নেতা মো. ফজলুর রহমান কাজল। ৩ জানুয়ারি বাগেরহাট কারাগারে খুলনার বিএনপি নেতা কামাল হোসেন মিজান মারা যান। গত ২৮ জানুয়ারি সাতক্ষীরা কারাগারে মারা যান বিএনপি নেতা আব্দুস সাত্তার খান।
এ বিষয়ে বিএনপির সহ আইনবিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ মো. জয়নুল আবেদীন মেজবাহ যুগান্তরকে বলেন, দেশে আওয়ামী লীগের একক শাসন চলছে। যে কারণে বিএনপির নেতাকর্মীদের জামিন দিতে চায় না আদালত। কারাবন্দি বিএনপির নেতারা খুব অসহায় অবস্থায় রয়েছে। যাদের ব্যবসা বাণিজ্য ছিল সেটা শেষ হয়ে গেছে। আয়ের উৎস নেই। তাদের ছেলে-মেয়েরা না খেয়ে থাকে। অনেকের পরিবারকে বাসা ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। পরিবারগুলো অমানবিক জীবনযাপন করছে। দীর্ঘদিন কারাগারে থাকায় অনেকেই অসুস্থ। সম্প্রতি কিছু লোক মারা যাওয়ার কারণে, স্বজনদের (বন্দি) জীবিত পাবেন কি না এটা নিয়ে অনেকে শঙ্কায় আছে।