সুবিধা থেকে বঞ্চিত রোগীদের পদে পদে খরচের বোঝা


, আপডেট করা হয়েছে : 17-02-2024

সুবিধা থেকে বঞ্চিত রোগীদের পদে পদে খরচের বোঝা

দীর্ঘদিন ধরে কোমর ব্যথাসহ শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগছেন ৩৩ বছর বয়সী সুরাইয়া আক্তার। গত বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জ থেকে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আসেন বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে। তাকে আরবিএস, সিআরপি, এসজিপিটি ও সেরাম ক্রিয়েটিনিনসহ ৮টি পরীক্ষা দেন চিকিৎসক। যার মাত্র দুটি সরকারি এ হাসপাতালে করানো সম্ভব হয়েছে; ছয়টিই করাতে হয়েছে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। এছাড়া তাকে তিন ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়। এর মধ্যে হাসপাতাল থেকে পেয়েছেন কেবল একটি। বাকি দুই ধরনের ওষুধ কিনতে হয়েছে বাইরে থেকে। বিনামূল্যে ডাক্তার দেখানো গেলেও রোগ নির্ণয় ও ওষুধ কেনায় সুরাইয়ার ১৭৭০ টাকা খরচ হয়েছে।


সুরাইয়া বলেন, ‘বিনা টাকায় শুধু ডাক্তার দেখাতে পেরেছি। সবই বাইরে থেকে করাতে হলো। মাকে সঙ্গে এনেছি। দুজনের আসতে লেগেছে ৩০০ টাকা। খাবার তো আছেই। খরচ যাতে কম লাগে, সে জন্য সরকারি হাসপাতালে আসা। কিন্তু কোনো লাভই হলো না!’


সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে এমন বাড়তি ব্যয়ের টাকা গোনার গল্প কেবল সুরাইয়ারই নয়। প্রতিদিন সেবা নিতে আসা হাজার হাজার রোগীর অবস্থা তথৈবচ। সরকারের এক গবেষণায়ও এমন চিত্রই উঠে এসেছে।


গবেষণা বলছে, সেবা নেওয়া ৭৪ শতাংশ রোগীকে অতিরিক্ত খরচের বোঝা টানতে হয়। যার বড় অংশই যায় রোগ নির্ণয় ও ওষুধের পেছনে। এখানেই সীমাবদ্ধ নয়, অধিকাংশের অভিযোগ চিকিৎসকরা মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শোনেন না। সেবা নিতে গেলেই বাধ্যতামূলকভাবে দিতে হয় ইনফরমাল টিপস বা ঘুষ।


বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাড়তি এই ব্যয়ের প্রধান কারণÑ সক্ষমতার তুলনায় সেবাপ্রার্থীর সংখ্যা কয়েকগুণ। এক্ষেত্রে উপজেলা ও জেলা হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।


‘রোগীর খরচ ও স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে সন্তুষ্টি’ শিরোনামে ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে গত বছরের মে পর্যন্ত সাত মাসব্যাপী গবেষণাটি করেছে ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল। হাসপাতালটির মেডিসিন, সার্জারি, অর্থোপেডিক্স, পেডিয়াট্রিকস ও গাইনোকোলজি অ্যান্ড অবস্ট্রাক্ট বিভাগে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা ৬৩৬ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় এ গবেষণায়।


এতে দেখা গেছে, রোগীর চিকিৎসা-ব্যয়ের পেছনে হাসপাতালের সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি নিয়ম-বহির্ভূত অর্থগ্রহণ, হাসপাতালে যাতায়াতে ব্যয়, ওষুধ ও রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা গ্রহণকালীন থাকা-খাওয়ার খরচকে যুক্ত করা হয়েছে।


গবেষণায় বলা হয়, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা প্রতি চারজনের তিনজনকে সরকার নির্ধারিত সেবামূল্যের বাইরে অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে সেবা নিতে হয়। শতকরায় যা প্রায় ৭৪ ভাগ। অতিরিক্ত এই খরচের হারকে অনেক বেশি বলে মনে করেন ১৮ শতাংশ রোগী।


প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিলেও রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ওষুধের অধিকাংশ নিতে হয় বাইরে থেকে। বাইরে হওয়া রোগ নির্ণয়ের খরচ ওষুধের চেয়েও বেশি। চিকিৎসকরা ব্যবস্থাপত্রে যে ওষুধ দেন তার ৬৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ ব্যক্তির নিজস্ব পকেট থেকে কিনতে হয়।


উদ্বেগের বিষয়, সেবাপ্রত্যাশী প্রায় ৯৭ শতাংশ রোগীর অভিযোগÑ চিকিৎসকরা তাদের বক্তব্য শোনেন না। হাসপাতালগুলোতে ট্রলি বহনকারী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও ওয়ার্ড বয়দের বাধ্যতামূলক ঘুষ দিতে হয় বলেও গবেষণায় উঠে এসেছে।


বাতজ্বর নিয়ে গত ৯ দিন ধরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন পটুয়াখালীর বাসিন্দা রাশিদা বেগম। ভুগছেন ডায়াবেটিসেও। শুরুতে জেলার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিলে অস্ত্রোপচারের জায়গায় ইনফেকশন (সংক্রমণ) দেখা দেয়।


গত বৃহস্পতিবার হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, দ্বিতীয় দফায় অস্ত্রোপচারের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন চল্লিশ বছর বয়সী এই নারী। পাশেই বসা ছেলে মো. হাবিবুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘অপারেশনের (অস্ত্রোপচার) জন্য ওষুধ থেকে শুরু করে সিরিঞ্জের তালিকা পর্যন্ত দিয়েছে। হাসপাতাল থেকে দেওয়ার কথা থাকলেও সাড়ে ৩ হাজার টাকায় বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মাকে হাসপাতালের ভেতরে আনার সময় ট্রলি প্রয়োজন হয়েছিল। এ জন্য ৫শ টাকা নিয়েছে। এখানে রোগী চলে যাওয়ার সময় ক্লিনারকে (পরিচ্ছন্নতাকর্মী) ২শ থেকে ৩শ টাকা বকশিশ দিয়ে খুশি করাতে হয়।


হাবিবুল্লাহ আরও বলেন, শুধু তাই নয়। ছয়টি পরীক্ষার তিনটিই করাতে হয়েছে বাইরে থেকে। খরচের শেষ নেই। পটুয়াখালী থেকে এখানে দুজন মানুষের আসতে লেগেছে দুই হাজার টাকা। তার ওপর রয়েছে ওষুধ ও টেস্টের খরচ। বেডটা (শয্যা) ছাড়া এখানে বিনামূল্যে কিছুই মেলে না।


গবেষকরা বলছেন, স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে রোগীদের ব্যয় কোথায়, কি কি এবং কীভাবে হচ্ছে সেটি দেখাই ছিল গবেষণার মূল লক্ষ্য। গবেষক দলের সদস্য সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আয়েশা আফরোজ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা দেখেছি সেবা নিতে আসা রোগীদের চিকিৎসা ব্যয়ের বড় অংশ চলে যাচ্ছে ডায়াগনোসিসে। শঙ্কার কথা হলো, সরকারি সুবিধায় যা ব্যয় হচ্ছে, তারচেয়েও বেশি যাচ্ছে পকেট থেকে। তার মানে আমাদের সুযোগ-সুবিধা যদি পর্যাপ্ত থাকত তাহলে এই বাড়তি ব্যয় রোগীর হতো না। পাশাপাশি কারণে-অকারণে রোগীকে বাইরে পাঠানোর একটি অনৈতিক চর্চাও পাওয়া গেছে গবেষণায়।’


তিনি বলেন, ‘জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের অনেক ক্ষেত্রে আমরা ওষুধ দিতে পারছি না। সেক্ষেত্রে বাইরে থেকে নিতে হচ্ছে। এ ছাড়া বিধিবহির্ভূত বকশিশ নেওয়া অনেকটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। জনবল ও যন্ত্রপাতির পাশাপাশি সবধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়মিত তদারকি হলে চিত্র অনেকটাই কমে আসবে।’


মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী মো. রশিদ-উন-নবী বলেন, ‘সেবার মান নিয়ে অভিযোগ থাকে না। কিন্তু শয্যার তুলনায় রোগীর চাপ বেশি থাকায় অনেক সময় রোগীরা তাদের সব কথা বলতে পারেন না। এই অবস্থার উত্তোরণে সরকারের সদিচ্ছার অভাব নেই।’


ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ‘শুধু স্বাস্থ্য নয়, সরকারের অধিকাংশ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে সেবা নিয়ে গিয়ে বাড়তি অর্থ প্রদান করতে হয়। আমরা দেখছি টারশিয়ারি হাসপাতালে প্রাথমিক সমস্যা নিয়ে রোগী দূর-দূরান্ত থেকে আসছেন। তার মানে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে এটি ঠিকঠাক পাচ্ছে না। এতে করে ব্যয় বাড়ছে।’


তিনি বলেন, ‘সময় দিয়ে রোগী দেখা ও তাদের কথা না শোনার জন্য ডাক্তারদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। প্রতিদিন একজন ডাক্তারের দেড়শ থেকে দুশ রোগী দেখা লাগে। তাহলে কীভাবে তিনি সময় নিয়ে কথা শুনবেন। সরকারের আমলাদের কর্মস্থল অনেক পরিপাটি হলেও চিকিৎসকদের কর্ম পরিবেশ অত্যন্ত খারাপ। ফলে রোগী এবং ডাক্তার উভয়েই এখানে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কেউই সন্তুষ্ট হতে পারছে না।’


জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ বলেন, ‘চিকিৎসা করাতে গিয়ে মানুষের কষ্ট হচ্ছে। মনে রাখতে হবেÑ ওষুধই চিকিৎসা নয়। এটার সঙ্গে আরও অনেক কিছু রয়েছে। এমন অবস্থা যাতে দেখা না যায় সেজন্য ২০১৫ সালের আগে থেকে সর্বজনীনের বিষয়ে জাতিসংঘ গুরুত্ব দিয়ে আসছে। কিন্তু এটি বাস্তবায়নে খুব একটা অগ্রগতি নেই।’


মহাপরিচালক আরও বলেন, এ অবস্থার উত্তরণে দরকার স্থানীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা। যেটি স্বাস্থ্যমন্ত্রী করতে এরই মধ্যে জোর দিয়েছেন। যে ব্যবস্থায় স্বাস্থ্য চলছে এটিতে হচ্ছে না। হয় নীতিতে নয়তো প্রয়োগে ঘাপলা আছে। কিন্তু সেটি কোথায় তা খুঁজে বের করতে হবে।



  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার