ঢাকার রেস্তোরাঁ যেন একেকটি মৃত্যুকূপ


, আপডেট করা হয়েছে : 02-03-2024

ঢাকার রেস্তোরাঁ যেন একেকটি মৃত্যুকূপ

রাজধানীর বাংলামোটর মোড়ে ২০ তলা ‘রূপায়ণ টাওয়ার’। লিফটে ভবনটির ১৯ তলায় গিয়ে একতলা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলে চোখে পড়ে ছাদজুড়ে বিশাল রেস্তোরাঁ ‘গ্রিন লাউঞ্জ’। মানুষের দৃষ্টি কাড়তে কাঠের পাটাতন আর বাঁশ-বেত দিয়ে সাজানো। ছাদের একাংশে অর্ধেক দখল করে সিঁড়ি দিয়ে আবার দোতলার মতো করে সেখানেও কাঠ আর বাঁশ দিয়ে সাজসজ্জা করা। সেখানে হাজারখানেক লোকের ধারণক্ষমতা। রেস্টুরেন্টের দুটি রান্নাঘরের একটি প্রবেশমুখে, অন্যটি ছাদের মাঝামাঝি। রেস্টুরেন্টটিতে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শত শত মানুষের ভিড় থাকে।


একই অবস্থা ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডের ‘দ্য ফরেস্ট লাউঞ্জ’ রেস্টুরেন্টের। ২০ তলা ভবনের ছাদের ওপর বিশাল রেস্তোরাঁ। তার প্রবেশপথে উন্মুক্ত চুলায় সারাক্ষণ রান্না চলে। পুরো ছাদে কাঠ ও বাঁশের সাজসজ্জা। আলোকসজ্জাও চোখ ধাঁধানো। একটি সরকারি সংস্থার নির্বাহী প্রকৌশলী আল মামুন রনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ঢাকা শহরে এ ধরনের রেস্টুরেন্টগুলো বাইরে দিয়ে আলোর ঝলকানিতে নজর কাড়লেও বাস্তবে একেকটা মৃত্যুকূপ। ধানমন্ডি সাতমসজিদ রোড ও খিলগাঁওয়ের তালতলা এলাকায় অনেকগুলো ভবনে ১০-১৫টি করে রেস্টুরেন্ট আছে। বেশির ভাগ ভবনেই একটি মাত্র ছোট লিফট।


সেখানে লোকজন লাইন ধরে ওঠানামা করে। ভবনে একটি করে সিঁড়ি এত সরু যে একজন মানুষ কোনোমতে চলতে পারে। এই সিঁড়িটিও নানা ধরনের পণ্য রেখে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। নিজের লব্ধ জ্ঞানের আলোকে বলতে পারি, এসব জায়গায় কোনো কারণে বেইলি রোডের মতো অগ্নিকাণ্ড ঘটলে প্রাণহানি আরও বাড়বে।’


এ বিষয়ে রাজউকের প্রধান নগর-পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘একটি ভবনে এভাবে এতগুলো রেস্টুরেন্ট খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এগুলো কোনোটারই অকুপেন্সি সনদ নেই। আবার যে হারে চুলা ব্যবহার করা হচ্ছে, সেখানেও কোনো নিয়মনীতির বালাই নেই। ফলে একটি রেস্টুরেন্টে আগুন লাগলে পুরো ভবনই জ্বলে ওঠে।’


সাতমসজিদ রোডের দুই পাশে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভবনগুলো রেস্টুরেন্টে ঠাসা। একই অবস্থা খিলগাঁও তালতলা এবং মিরপুরের কয়েকটি সড়কসংলগ্ন এলাকার। গত ১০ বছরে প্রথমে চালু হয় একই ভবনের পুরোটাতে রেস্টুরেন্ট বানানোর রেওয়াজ। এরপর শুরু হয় রুফটপ রেস্টুরেন্ট। ইস্কাটনে বোরাক টাওয়ারের ২০ তলায় সেইলো, পুরানা পল্টনে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উল্টোদিকে ২২ তলার ওপরে বার্ডস আই, মিরপুর ১ নম্বর সেকশনে স্কাই লাউঞ্জ, শ্যামলী রিং রোডে রেডরেস, বেইলি রোডে মহিলা সমিতির ওপরে মেড সেইফ, রূপায়ণ স্বপ্ন নিলয় ভবনে গ্রিন লাউঞ্জ, বনশ্রী এ ব্লকে ওয়াটার গার্ডেন, শান্তিনগরে ২৩ তলা ভবনের ছাদে স্কাই ভিউ, কারওয়ান বাজারে বিটিএমসি ভবনের ২০ তলার ছাদে রেইনি রেস্টুরেন্ট। প্রতিটি রেস্টুরেন্টেই অযাচিত সাজসজ্জা করা হয়েছে। প্রতিটি ছাদে বারবিকিউ করার জন্য উন্মুক্ত চুলা। কাঠের পাটাতন আর কোথাও কোথাও শণ-খড়-বাঁশ দিয়ে কুঁড়েঘরও বানানো হয়েছে।


বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এসব দাহ্য নির্মাণ উপকরণে আগুনের ছোঁয়া লাগলে মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে পড়ে জায়গাটি আগুনের চুল্লিতে পরিণত হবে।


বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি)-২০২০ এবং ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ অনুযায়ী, ভবন ব্যবহারের জন্য অনুপেন্সি সার্টিফিকেট (বসবাস বা ব্যবহার সনদ) নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। এসব রেস্টুরেন্টের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নেওয়া হয় না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব দেখার দায়িত্বে আছে রাজউক, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর, কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ, বিস্ফোরক অধিদপ্তর। সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা এগুলো না দেখার মতো থাকেন।


স্থপতি ইকবাল হাবিব আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ছয়-সাতটি সংস্থা এসব দেখভালের দায়িত্বে আছে। তারা কেউ এসব দেখে না; অথবা আপস করে চলে। ইমারত নির্মাণ আইন ও বিএনবিসি অনুযায়ী ভবনের ছাদে তো রেস্টুরেন্ট করার সুযোগ নেই। ভবনে আগুন লাগলে মানুষ ছাদে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে উঁচু মই দিয়ে নামিয়ে আনা হয়। কিন্তু ছাদে যদি রেস্টুরেন্ট থাকে আর সেখানে চুলা থেকে আগুন ধরে, তাহলে একটি মানুষেরও বাঁচার উপায় থাকবে না। তাই দ্রুত এসব বন্ধ করা উচিত।’  


রাজউকের প্রধান স্থপতি মোশতাক আহমেদ কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, ‘আমরা সবকিছু দেখেই নকশা অনুমোদন করে থাকি। কিন্তু একজন ভবনমালিক নিয়ম মেনে ভবন তৈরি করে পরে ধীরে ধীরে অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয় করে ব্যবহার করেন। নকশা অনুমোদন নেওয়ার পর সিঁড়ি ও উন্মুক্ত স্থানগুলো নানা কাজে ব্যবহার করে থাকে। সব সময় তা নজরদারিতে রাখা মুশকিল।’ 



  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার