কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রায় ৮৪ শতাংশ কেন্দ্রে এককভাবে জয় পেয়েছেন ডা. তাহসীন বাহার সূচনা। এ নির্বাচনের ১০৫টি ভোটকেন্দ্রের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৮৮টি ভোটকেন্দ্রে অন্য তিন প্রার্থীর চেয়ে তিনি বেশি ভোট পেয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক দুইবারের মেয়র মো. মনিরুল হক সাক্কু মাত্র ১৫টি ভোটকেন্দ্রে অন্যদের চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন। ভোট পাওয়ার সংখ্যা বিবেচনায় ১০১টি কেন্দ্রে সাক্কুর অবস্থান দ্বিতীয়। তবে তিনি যে কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন সে কেন্দ্রেও তিনি হেরেছেন। এমনকি তার নিজ এলাকা ১২ নম্বর ওয়ার্ডের চারটি কেন্দ্রের সবগুলোতেই তিনি ডা. তাহসীন বাহার সূচনার কাছে পরাজিত হয়েছেন। এ নির্বাচনের ফলাফলে তৃতীয় অবস্থানে থাকা বিএনপির বহিষ্কৃত আরেক নেতা মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন কায়সার মাত্র দুটি কেন্দ্রে জয়ী হয়েছেন। বারবার নির্বাচন করলেও একটি কেন্দ্রেও জয়ী হতে পারেননি হাতি প্রতীকের প্রার্থী নূর-উর রহমান মাহমুদ তানিম। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ১০৫টি ভোটকেন্দ্রের ফলাফল বিশ্লেষণে এসব চিত্র দেখা গেছে। বিক্ষিপ্ত দু-একটি ঘটনা ছাড়া শনিবার কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে উপনির্বাচনে শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ হয়। এ নির্বাচনে বাস প্রতীকে ডা. তাহসীন বাহার সূচনা ৪৮ হাজার ৮৯০ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা মনিরুল হক সাক্কু টেবিল ঘড়ি প্রতীকে পান ২৬ হাজার ৮৯৭ ভোট। দুজনের প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান ২১ হাজার ৯৯৩টি। অপর দুই প্রার্থী মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন কায়সার ঘোড়া প্রতীকে ১৩ হাজার ১৫৫ ভোট এবং নূর-উর রহমান মাহমুদ তানিম হাতি প্রতীকে পেয়েছেন পাঁচ হাজার ১৭৩ ভোট। এ নির্বাচনে দুই লাখ ৪২ হাজার ৪৫৮টির মধ্যে ভোট দিয়েছেন ৯৪ হাজার ১১৫ জন। ভোট পড়ার হার ৩৮ দশমিক ৮২ শতাংশ। রোববার এ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষণা করেন মো. ফরহাদ হোসেন। এর আগে শনিবার সন্ধ্যায় নগরীর কুমিল্লা জিলা স্কুলের অডিটরিয়ামে তিনি বেসরকারি প্রাথমিক ফল ঘোষণা করেন।
ফলাফল বিশ্লেষণে আরও দেখা গেছে, ডা. সূচনা নিজ এলাকার পাশাপাশি সাক্কু এবং আওয়ামী লীগের নেতা সাবেক সংসদ-সদস্য আঞ্জুম সুলতানা সীমার ভোট ব্যাংক হিসাবে পরিচিত ৭ ও ৮নং ওয়ার্ডের কেন্দ্রগুলোতে বেশি ভোট পেয়েছেন। সীমার সমর্থকরা সূচনা বিরোধী শিবির হিসাবেই পরিচিত।
স্থানীয় রাজনীতিক ও সমাজকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ নির্বাচনের ফলাফল অনেকটা অনুমেয় ছিল। এই ফলাফলের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ কাজ করেছে বলে মনে করেন তারা। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে অনেক শক্তিশালী। সূচনার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সদর আসনের সংসদ-সদস্য। এছাড়া সূচনা নিজে মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। পাশাপাশি জাগ্রত মানবিকতা নামে তার একটি সামাজিক সংগঠন রয়েছে। যার মাধ্যমে তিনি তৃণমূলের মানুষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তুলেছেন। এছাড়া প্রয়াত মেয়র আরফানুল হক রিফাত নগরীতে ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করেন। ওই কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য সূচনাকে ভোট দেওয়ার প্রচার চালানো হয়।
অপরদিকে মনিরুল হক সাক্কু বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত থাকায় দলটির নেতাকর্মীদের বড় অংশ তার পক্ষে ছিলেন না। তার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও নগরীর কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন করতে না পারার ব্যর্থতারও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া একই দলের বহিষ্কৃত নেতা নিজাম উদ্দিন কায়সারও এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তার পক্ষে স্থানীয় বিএনপির অনেক নেতাকর্মী কাজ করেন। সরকারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসাবে বিএনপির নেতাকর্মীদের বড় অংশ এ নির্বাচনে ভোট দিতে যাননি। সব মিলিয়ে সাক্কু এ নির্বাচনে ভোটের বড় ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন। যদিও সাক্কু এবং কায়সারের অভিযোগ, নানা কৌশলে ভোটারদের জিম্মি করে জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন সূচনা। নগরীর প্রতিটি অলিগলিতে বাস প্রতীকের কর্মী-সমর্থকদের মহড়া এবং মারমুখী অবস্থান ছিল। কেন্দ্র এবং আশপাশ এলাকা ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। যার ফলে ভয় ও আতঙ্কে সাধারণ মানুষ কেন্দ্রে আসেননি। কায়সার বলেন, আমার ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া হয়েছে। তাদের কেন্দ্রের সামনে থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। একমাত্র বাস প্রতীকের ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পেরেছেন। আসলে এটি ছিল একটি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন। যার চাবিকাঠি ছিল ক্ষমতাসীনদের হাতে।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে নবনির্বাচিত মেয়র ডা. তাহসীন বাহার সূচনা বলেন, পরাজিত প্রার্থীরা কখনো তাদের দুর্বলতার কথা প্রকাশ করতে চান না। নগরবাসী দুর্নীতিবাজদের আর কখনো জনপ্রতিনিধির আসনে দেখতে চায় না। তিনি বলেন, সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে আমার বিজয় হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রত্যেক নেতাকর্মী আমার জন্য কষ্ট করেছেন। ভোটারদের দ্বারে দ্বারে তারা গিয়েছেন। ফলে আমার বিজয় সুনিশ্চিত হয়েছে।
নিজ ওয়ার্ডে হেরেছেন সাক্কু : কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলে দেখা গেছে, নগরীর ১২ ওয়ার্ডে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করেন মনিরুল হক সাক্কু। এখানেই তিনি ভোটার। এ ওয়ার্ডের চারটি কেন্দ্রেই তিনি হেরেছেন। হোচ্চামিয়া উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে সাক্কু পেয়েছেন ৩০৯ ভোট। অপরদিকে এ কেন্দ্রে সূচনা পেয়েছেন ৩২৯ ভোট। ১৯৩২ ভোটারের এ কেন্দ্রে ৮১০টি ভোট পড়েছে, যা মোট ভোটারের ৪১.৯৩ শতাংশ। নবাব হোচ্ছাম হায়দার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সাক্কু পেয়েছেন ৩০০ ভোট আর সূচনা পেয়েছেন ৩৪৪ ভোট। এ কেন্দ্রে ১৬৮৫ ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ৯০৬ জন। একইভাবে শৈলরানী দেবী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থাপিত দুটি কেন্দ্রে ২৩১ ও ২৫৪টি ভোট পেয়েছেন সাক্কু। আর বিজয়ী সূচনা পেয়েছেন যথাক্রমে ৪৮১ ও ২৬৪ ভোট।
এ নির্বাচনে ১৫টি কেন্দ্রে সাক্কু বেশি ভোট পেয়েছেন। সেগুলো হচ্ছে-বিষ্ণুপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নতুন ভবন, বিষ্ণুপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পুরাতন ভবন, ভাটপাড়ার নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র-৩, ইসলামী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় (নিচ তলা), গোবিন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রামকৃঞ্চ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কুমিল্লা মডার্ন স্কুল (প্রাইমারি শাখা, মূল ভবন নিচ তলা), হোচ্ছামিয়া লুৎফুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (পদ্মা ভবন), তেলিকোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (বঙ্গবন্ধু ভবন), বিসমিল্লাহ কিন্ডারগার্টেন, কুমিল্লা হাউজিং এস্টেট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, কুমিল্লা সরকারি সিটি কলেজ (দক্ষিণ পার্শ্বের হলরুম), জয়পুর সার্বজনীন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গন্ধমতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ও গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল।
দুই কেন্দ্রে জয়ী কায়সার : কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলে দেখা গেছে, ১০৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে মাত্র দুটিতে অন্য তিন প্রার্থীর চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন কায়সার। কেন্দ্র দুটি হচ্ছে-হাউজিং এস্টেট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কাটাবিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র। হাউজিং এস্টেট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে কায়সার পেয়েছেন ৩৯২ ভোট। এ কেন্দ্রে তাহসীন বাহার সূচনা ৩৪৪ ভোট ও মনিরুল হক সাক্কু ২৮৬ ভোট পেয়েছেন। ভোট পড়ার হার ৪৮.১০ শতাংশ। কাটাবিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে কায়সার পেয়েছেন ৩৪৪ ভোট। এ কেন্দ্রে তাহসীন বাহার সূচনা ৩১১ ভোট ও মনিরুল হক সাক্কু ২১১ ভোট পেয়েছেন। ভোট পড়ার হার ৩৮.০৬ শতাংশ।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সূচনার ফোনালাপ : ফলাফল হাতে পেয়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফোনে কথা বলেন সূচনার বাবা কুমিল্লা-৬ আসনের বাহাউদ্দিন বাহার। একপর্যায়ে বাহার ফোন বাড়িয়ে দেন মেয়ের হাতে। এ সময় সূচনা এতটাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন যেন মুখ থেকে কথা বের হচ্ছিল না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সময় সূচনা পথচলায় দোয়া কামনা করেন। আবদার করেন দ্রুত যেন দেখা করার সুযোগ পান। অপর প্রান্ত থেকে নিরাশ করেননি প্রধানমন্ত্রী। ফোনালাপ শুনে আঁচ করা গেছে, সাক্ষাতের জন্য দপ্তরের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।