এনসিটিবির পাঠ্যবই মুদ্রণ: ৯৪৫ কোটি টাকার কাজে ২৪৫ কোটি টাকার অনিয়ম


, আপডেট করা হয়েছে : 28-03-2024

এনসিটিবির পাঠ্যবই মুদ্রণ: ৯৪৫ কোটি টাকার কাজে ২৪৫ কোটি টাকার অনিয়ম

একই মান ও স্পেসিফিকেশনের (আকার, কাগজের উজ্জ্বলতা, প্রচ্ছদ, পৃষ্ঠাসংখ্যা, বাঁধাই) বই হলেও ছাপানো হয়েছে ভিন্ন দামে। দরপত্রে মানা হয়নি নিয়ম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ দেওয়া হয়নি। আলাদা ‘ইন্সপেকশন এজেন্ট’ নিয়োগ দিয়েও বই ছাপানো দেখভালের নামে লাখ লাখ টাকা পকেটে পুরেছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।


২০২৩ শিক্ষাবর্ষের বিনা মূল্যের পাঠ্যবই ছাপানোর কাজে এমন আরও অনিয়ম পেয়েছে বাংলাদেশ মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের অধীন শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর। সংস্থাটির নিরীক্ষা বলছে, এসব অনিয়মের কারণে সরকারের প্রায় ২৪৫ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এর বাইরে আরও ২৫ কোটি টাকার অনিয়মেরও প্রমাণ মিলেছে। এসব বিষয়ে অডিট আপত্তি জানিয়ে এর জবাব দিতে অধিদপ্তর গত ২৯ জানুয়ারি এনসিটিবির চেয়ারম্যানকে আধা সরকারি পত্র দিয়েছে। অধিদপ্তর ও এনসিটিবি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।


নিরীক্ষার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী ২৫ মার্চ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান জিরো টলারেন্স। এ ক্ষেত্রে কারও বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’


২০১০ সাল থেকে শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎসব করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে পাঠ্যবই দিচ্ছে সরকার। ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে প্রায় ৩৪ কোটি পাঠ্যবই ছাপানো হয়। এতে ব্যয় হয় ৯৪৫ কোটি ৬৪ লাখ ২৮ হাজার ৭৭৩ টাকা।


এনসিটিবি ও নিরীক্ষা প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে প্রথম প্যাকেজে ২৮০টি লটে বই ছাপানোর দরপত্র আহ্বান করা হয়। এনসিটিবি প্রথম ৪৩ লটের ফর্মাপ্রতি (প্রতি ফর্মায় ৮ পৃষ্ঠা) প্রাক্কলিত দর নির্ধারণ করে ২ টাকা ৬৮ টাকা। এসব লটে সর্বনিম্ন উদ্ধৃত দর ফর্মাপ্রতি শূন্য দশমিক ৬৯ টাকা। বাকি ২৩৭ লটের প্রাক্কলিত দর ১ টাকা ৬৩ পয়সা। এসব দরপত্রে সর্বনিম্ন উদ্ধৃত দর ১ টাকা ৪৮ পয়সা থেকে শূন্য দশমিক ৩১ পয়সা। অর্থাৎ ২৮০টি দরপত্রের স্পেসিফিকেশন, ব্যয়সীমা এবং দরপত্র আহ্বানের সময় একই থাকলেও লটভেদে উদ্ধৃত দর ছিল ভিন্ন। ফলে একই ধরন ও মানের বই ছাপতে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন দামে।


নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, অধিকাংশ লটে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ না দিয়ে দেওয়া হয়েছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সর্বনিম্ন দরদাতাকে। এ ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন দরদাতাকে ‘নন-রেসপনসিভ (মুদ্রণ সক্ষমতা অতিরিক্ত হওয়া, উৎপাদন সক্ষমতা নেই)’ দেখানো হয়েছে। অথচ এমন প্রতিষ্ঠানকেই অন্য লটের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে।


অনিয়মের বিষয়ে জবাব চেয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যানকে দেওয়া শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের চিঠিতে বলা হয়েছে, বই ছাপায় দরপত্রে অনিয়মের কারণে সরকারের ২৩৫ কোটি ৩০ লাখ ৫৭ হাজার ৭৮৫ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। চিঠিতে এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এবং অর্থ আদায় করে এনসিটিবির তহবিলে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রথম সর্বনিম্ন দরদাতাকে কার্যাদেশ না দেওয়ায় অতিরিক্ত ৬ কোটি ৫৩ লাখ ৪১ হাজার ২৮৭ টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। এ জন্য জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।


জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম ২৪ মার্চ আজকের পত্রিকাকে বলেন, অনেক সময় চাইলেও সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ দেওয়া সম্ভব হয় না। দেখা যায়, মুদ্রণযন্ত্রের সক্ষমতা শেষ হয়ে গেছে। শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনের বিষয়ে তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী অডিট আপত্তিগুলোর জবাব দেওয়া হবে।


এনসিটিবির কর্মকর্তা ও মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে সরকারের বিনা মূল্যের পাঠ্যবই ছাপানোর কাজে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। দরপত্র প্রক্রিয়ায় জড়িত ব্যক্তিদের ‘অনৈতিক আবদার’ রক্ষা না করায় এনসিটিবির কর্মকর্তাকে বদলির অভিযোগও রয়েছে। ২০১৬ সালে প্রথম প্রাক্কলিত দরের চেয়ে কম দরে কাজ দেওয়া হয়েছিল। ২০১৭ সালে শিক্ষার্থীদের দেওয়া অধিকাংশ বই নিম্নমানের হওয়ায় ব্যাপক সমালোচনা হয়। তারপরও একই কৌশলে কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে সংঘবদ্ধ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।


বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, ‘বই ছাপানোর দরপত্রে এ ধরনের অনিয়ম ওপেন সিক্রেট। এ বিষয়ে নতুন করে কিছু বলতে চাই না।’

নিরীক্ষা প্রতিবেদন ও এনসিটিবির হিসাবসংক্রান্ত নথির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে বই ছাপার কাজ দেখাশোনার জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রায় ৭৪ লাখ টাকা সম্মানী দেওয়া হয়। অথচ এই কাজের জন্য ‘ইনডিপেনডেন্ট ইন্সপেকশন সার্ভিসেস বিডি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এনসিটিবির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উৎসব ভাতা ছাড়া আরও চারটি ভাতা পান। সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এর বাইরে আর কোনো ভাতা দেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা।


নিরীক্ষা আপত্তিতে বলা হয়েছে, বই ছাপানোর কাজে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে (দরপত্র উন্মুক্তকরণ, মূল্যায়ন ও অন্যান্য) নির্দিষ্ট সীমার বেশি সদস্য নিয়ে এবং প্রাপ্যতার অতিরিক্ত হারে ও প্রাপ্য না হলেও ৬৪ লাখ ৭২ হাজার ৩০ টাকার অতিরিক্ত সম্মানী দেওয়া হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, দরপত্র উন্মুক্তকরণ কমিটিতে তিনজন, মূল্যায়ন কমিটিতে সাতজন সদস্য থাকবেন। এই অতিরিক্ত সম্মানীসহ ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রাপ্যতা না থাকলেও সম্মানী ও উদ্দীপনা ভাতা দেওয়ায়, আয়কর না কাটায়, অতিরিক্ত হারে প্রশিক্ষণ-কর্মশালা ভাতা ও নির্দিষ্ট সীমার বাইরে অতিরিক্ত অর্থ অগ্রিম দেওয়ায় প্রায় ২৫ কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে। এসব বিষয়েও এনসিটিবিকে ব্রডশিটে জবাব দিতে চিঠি দিয়েছে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর।


অধিদপ্তরের চিঠিতে বলা হয়, বিভিন্ন উদ্দেশ্যে নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত ৭ কোটি ৫৫ লাখ ৮ হাজার ১১২ টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের অনুমোদনের কপি পাঠাতে সুপারিশ করা হয়। সার্ভিস চার্জ এবং প্রদত্ত সম্মানী থেকে আয়কর না কাটায় ৫ কোটি ৮৮ লাখ ১৩ হাজার ৬৭৬ টাকা এবং ভ্যাট আদায় না করায় ৮ কোটি ৪৫ লাখ ৫৬ হাজার ৯৬৩ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এসব অর্থ আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে সুপারিশ করা হয়।


ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, বিনা মূল্যে পাঠ্যবই দেওয়া সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। এতে শিক্ষার্থীরা সরাসরি উপকৃত হয়। এ ক্ষেত্রে অনিয়ম উদ্বেগজনক। যথাযথ তদন্ত করে এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের উচিত এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনকেও কাজে লাগানো।



  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার