বোরোর বাম্পার ফলনে হাওড়ে উৎসবের আমেজ


, আপডেট করা হয়েছে : 23-04-2024

বোরোর বাম্পার ফলনে হাওড়ে উৎসবের আমেজ

হাওড়াঞ্চলে এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। এতে হাজার হাজার কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে। কৃষকরা বলছেন এবার প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ধান গোলায় তুলবেন তারা। হাওড়জুড়ে এখন উৎসবের আমেজ। ধান কাটা, মাড়াই, সিদ্ধ করা ও শুকানোর কাজে ব্যস্ত কৃষাণ-কৃষাণী। আগাম বন্যার আশঙ্কা থাকলেও মেঘালয়ে বৃষ্টি কম হওয়ায় সব হাওড়ে এবার ফলন ভালো হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় দ্রুত ধান কাটছেন কৃষকরা। তবে শ্রমিক সংকট থাকায় হারভেস্টর ব্যবহার করা হচ্ছে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজে।


সুনামগঞ্জ থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, জেলার হাওড়াঞ্চলের অধিকাংশ হাওড়ে আগাম জাতের হাইব্রিড ধান ও দেশী জাতের ধান কাটা দ্রুত শুরু করেছে কৃষকরা। জেলা সদর, শান্তিগঞ্জ, দোয়ারাবাজার, উপজেলার বড় হাওড় ডেকার হাওড়। এ হাওড়ের একশ হেক্টরের বেশি ও সদর উপজেলার কালনার হাওড়ের কিছু অংশে জলাবদ্ধতা দেখা দিলেও কর্তৃপক্ষ দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেওয়ায় তেমন ক্ষতি হবে না বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ। এবার সুনামগঞ্জে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬১২ হেক্টর বেশি জমিতে ধান উৎপাদন হয়েছে এবং যার বাজার মূল্য প্রায় চার হাজার একশ কোটি টাকা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আগামী ৫ মে-এর ভেতরে পুরো হাওড়ের ধান কাটা শেষ হবে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি কর্মকর্তারা।


এর মধ্যে উচ্চ ফলনশীল (উফশী) জাতের আবাদ বেশি হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ। কৃষকগণ স্থানীয় জাতের ধানের আবাদ তুলনামূলকভাবে কম করেছে এবার। কারও কারও মতে নেই বললেই চলে। উফশী জাতের ধানের আবাদ হয়েছে ২ লক্ষ ২২ হাজার ২১৪ হেক্টর এবং স্থানীয় জাতের ধান ১ হাজার ১৯৩ হেক্টর, যা গত দুই বছরের তুলনায় ৬ হাজার ৬৬৮ হেক্টর বেশি। বোরো আবাদের এই অগ্রগতিকে অন্য যে কোনো বছরের তুলনায় বেশি দাবি কৃষি বিভাগের।


এ বছর রপ্তানিযোগ্য আর প্রিমিয়াম কোয়ালিটির বিনা ধান পঁচিশসহ বিনা ছাব্বিশ ব্রি ধান ৮৯, ব্রি ধান ৯২, ব্রি ধান ৯৬, শক্তি, সুরবী, হাইব্রিড ১,৮৯,৯২সহ বঙ্গবন্ধু ১০০, বঙ্গবন্ধু ১০১সহ ৩৭ জাতের উফশী ধান আবাদ হয়েছে। এই আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার পেছনে প্রাকৃতিক অনুকূল পরিবেশকে প্রাধান্য দিচ্ছেন কৃষকরা।


জেলার তাহিরপুর উপজেলার সবচেয়ে বড় হাওড় মাটিয়ান হাওড়, শনির হাওড়, দিরাই ও শাল্লা উপজেলার ছায়ার হাওড়, জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়ার হাওড়সহ অধিকাংশ উপজেলার হাওড়ের ধান কাটা শুরু হয়েছে। খরচার হাওড়ের কৃষক মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, হাওড়ে আগাম জাতের ধান পেকে যাওয়ায় কাঁচা-আধাপাকা কেটে আনতেছি। দিন ভালো থাকায় ধানগুলো শুকানো যাচ্ছে ভালোভাবে। ধান কাটার মেশিন ব্যবহার করায় অন্যান্য বছরের তুলনায় দ্রুত ধান কাটা যাচ্ছে।


ডেকার হাওড়ের কৃষক আনসার মিয়া বলেন, এবার হাওড়ে ১২ বিঘা জমি চাষ করেছি। এখনো ধান পাকেনি। কাঁচা-আধাপাকা রয়েছে। বান্দের (বাঁধের) পানির জলাবদ্ধতায় প্রায় ৬/৭ বিঘা জমির ধান পানির নিচে। এবার ধানের ফলন ভালো হয়েছে। আল্লায় দিলে এবার ভাতের অভাব থাকত না। তবে হাওড়বাসীর প্রতিবছরই বন্যার আশঙ্কা থাকে। হাওড়ের বাঁধ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও আবহাওয়া সম্পূর্ণ অনুকূলে থাকার ফলে সেদিকে কৃষকদের নজর কম। এবার জমির ধান নিয়ে খুব একটা শঙ্কায় নেই কৃষকরা।


কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে জেলার ১২টি উপজেলায় চলতি বছর ২ লাখ ২৩ হাজার ৪০৪ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ করা হয়েছে। এতে ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩ লাখ ৭০ হাজার ২০০ মেট্রিক টন। যার বাজার মূল্য প্রায় চার হাজার একশ কোটি টাকা। গেল বছর ২ লাখ ২২ হাজার ৭৯৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। গত বছরের তুলনায় এবার ৬শ ১২ হেক্টর বেশি জমিতে ধান আবাদ করা হয়েছে। তবে হাওড়ের এবার ব্রি-২৮ এবং ব্রি-২৯ জাতের ধানের বিকল্প হিসেবে কৃষকরা নতুন জাতের ধান চাষাবাদ করেছে। তাতেও ফলন ভালো হয়েছে।


কৃষি  বিভাগের দাবি, সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ সভা-সমাবেশ-ট্রেনিং এবং সময়মতো বিনামূল্যে সার বীজ কীটনাশক সরবরাহসহ মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তাদের নিয়মিত পরামর্শ ও তদারকি রয়েছে, তবে কৃষকরা বলেছেন, অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ বিরাজমান থাকায় বোরো আবাদে গত দুই বছরের তুলনায় এবারে অর্জন ভালো হয়েছে।


জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, জেলার শনির হাওড়, মাটিয়ান হাওড়, নলুয়ার হাওড়, ডেকার হাওড়সহ অধিকাংশ হাওড়ের ধান কাটা শুরু হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এবার ধানের আবাদ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি হয়েছে। ফলনও ভালো হয়েছে।


ধর্মপাশা থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, উপজেলায় বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানা যায়, চলতি ইরি-বোরো মৌসুমে উপজেলায় ৩২ হাজার ৭৬০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষাবাদ করা হয়েছে। যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৯৬ হাজার মেট্রিক টন।


উপজেলা কৃষি অফিসার মোহাম্মদ মীর হাসান আল বান্না জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা অফিসে বসে কৃষকদের সুপরামর্শের সেবা দিয়েই দায়িত্ব শেষ নয় আমাদের উপসহকারী কৃষি অফিসাররা ইউনিয়নের প্রতিটি কৃষকের বাড়ি বাড়ি অথবা তাদের কৃষি জমিতে গিয়ে কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছেন। ফলে কৃষকরা আজ বাম্পার ফলনে সুফল অর্জন করেছে। এ বছর যে সমস্ত কৃষক আমাদের পরামর্শ অনুযায়ী ভুট্টা চাষাবাদ করেছে তারাও বাম্পার ফলন উৎপাদন করেছেন। ভুট্টা চাষ একটি লাভজনক ব্যবসা।


কিন্তু কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। বিগত বছরের চেয়ে এ বছর কৃষি উপকরণ রাসায়নিক সার, কীটনাশকের মূল্য দ্বিগুণ হওয়ায় কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।


এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি অফিসার মীর হাসান আল বান্না বলেন, কৃষকদের জমিতে বিভিন্ন ধরনের চারা সংগ্রহ, ধান রোপণ, সময়মতো কীটনাশক ব্যবহারসহ আমাদের মাঠকর্মীরা প্রতিটি কৃষকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন। এ বছর বোরো ধান কর্তনের শ্রমিক সংকটের কারণে আমরা কামারবাড়ী আমাদের হেড অফিসে যোগাযোগ করে ভর্তুকির মাধ্যমে পর্যাপ্ত হারভেস্টর মেশিন কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আগামী ১০/১৫ দিনের মধ্যে ধান কাটা, মাড়াই ও গবাদিপশুর খাদ্য সংগ্রহ সম্পন্ন হবে।


নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, উপজেলার ডিঙ্গাপোতা হাওড়সহ নিম্নাঞ্চলে পুরোদমে নতুন ধান কাটা শুরু হয়েছে। বোরো ধানের বাম্পার ফলনে হাসি ফুটেছে ৩৬ হাজার কৃষক পরিবারের মাঝে। ভালো ফলন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকার পাশাপাশি ধানের ন্যায্য মূল্যও পাচ্ছেন কৃষকরা। উপজেলা কৃষি বিভাগ জানায়, এ বছর উপজেলায় ১৬ হাজার ৯শ ৭০ হেক্টরের মধ্যে হাওড়ের নিম্নাঞ্চলে সাড়ে ৬ হাজার ৫শ হেক্টর বোরো ধান আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে শনিবার পর্যন্ত ২৬ শতাংশ সার্বিক ও হাওড়ের নিম্নাঞ্চলে ৬৮ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। প্রধান জাত ব্রি-৮৮, ব্রি-৮৯, ব্রি- ৯২, জনকরাজ, ইস্পাহানী- ৬ সহ উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড ধান। এসব ধানের বাজারমূল্য ৯৬০ টাকা থেকে ৯০০ টাকা পর্যন্ত।


হাওড়পাড়ের উপজেলা মোহনগঞ্জ তেতুলিয়া মাইজপাড়া গ্রামের কৃষক শওকত আলী ধানের ফলনে ভীষণ খুশি। ধানের ফলন কেমন হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বছর ৮০ কাঠা জমিতে ব্রি-৮৮ জাতের আবাদ করেছিলেন। সব জমির ধান কাটা, মাড়াই ও শুকানোর পর গোলায় তুলেছেন। সব মিলিয়ে ৭শ ৫০ মণ ধান পেয়েছেন।’


মোহনগঞ্জ উপজেলার গৌড়াকান্দা গ্রামের কৃষক মালেক তালুকদার বুরুজ মিয়া বলেন, এবার তিনি ব্রি-৮৮ ও ব্রি-৮৯ জাতের ধান লাগিয়েছিলেন। ধান পেয়েছেন ২শ মণের মতো। উপজেলার খুরশিমূল গ্রামের ধান ব্যবসায়ী মোজাম্মেল মিয়া জানান, আমরা হাওড় থেকে ব্রি-৮৮ জাতের ধান ৯৬০ টাকা থেকে ৯৮০ টাকায় ক্রয় করছি। এবার ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ জাতের ধান একেবারেই কৃষকরা আবাদ করেননি।


মোহনগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুস শাকুর সাদি জানান, এবার ধান কাটার শ্রমিক পাওয়া নিয়ে কৃষকদের কোনো সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না। হাওড়ের কৃষক ফসল তোলার কাজ আরও সহজ করতে কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহার করছেন। উপজেলায় ১০০টি কম্বাইন হারভেস্টারে ফসল কাটা, মাড়াই ও ঝাড়ার কাজ করছে। সাদি বলেন, ‘একটি কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে এক ঘণ্টায় এক একর জমির ধান কাটা যায়। তিনি আরও বলেন, প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ না হলে মে মাসের মধ্যভাগে হাওড়ে আবাদ করা শতভাগ জমির ধান কাটা সম্ভব। প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ধান পাবেন বলে কৃষকের মাঝে হাওড় জুড়ে অন্যরকম এক উৎসব চলছে। দিনরাত ব্যস্ত হাওড়ের কৃষক পরিবারের লোকজন। যেভাবে ধান কাটা হচ্ছে চলতি মাসের শেষের দিকেই ৯০ শতাংশ ধান কাটা শেষ হবে বলে আশা করছে কৃষকরা।



  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার