ফল-ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা


, আপডেট করা হয়েছে : 29-04-2024

ফল-ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা

দেশব্যাপী তীব্র দাবদাহে কৃষির উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অনেক জেলায় দেখা দিয়েছে পানি সংকট। এতে ফলমূল ও ফসল ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছে। দাবদাহের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। ফলে চাহিদামতো ফল ও ফসলের জমিতে পানি সরবরাহ করতে পারছেন না কৃষক। যে কারণে গত বছরের চেয়ে চলতি বছর আম উৎপাদন ৪০ শতাংশ কম হবে। কমে যাবে লিচুর উৎপাদনও। কৃষি গবেষকরা বলছেন, রোদ বা সূর্যের আলো কৃষির জন্য ক্ষতিকারক নয়, বরং উপকারী। কিন্তু অতি তাপমাত্রা বা তাপপ্রবাহ কিংবা শৈত্যপ্রবাহ কৃষির জন্য সহায়ক নয়। সেই অসহিষ্ণু পরিস্থিতির ওপর দিয়েই যাচ্ছে এখন দেশের মানুষ।


কৃষিবিদরা বলছেন, চলমান দাবদাহে সমস্যা হচ্ছে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া। ফলমূল ও ফসলের গাছের গোড়ায় পানি পৌঁছানো জরুরি। গাছের গোড়ায় পানি নিশ্চিত করা গেলে তাপমাত্রা আরো ২-৪ ডিগ্রি বৃদ্ধিতে গাছের কোনো ক্ষতি হবে না। গাছের ক্ষতি না হলে ফল ও ফসলেরও কোনো ক্ষতি হওয়ার কথা না। কিন্তু বৃষ্টি না হওয়ায় পরিস্থিতি দিনকে দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। ফলে ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।


তীব্র দাবদাহ তথা হিট শকে মাঠের বোরো ধানের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। ইতঃপূর্বে এ ধরনের অবহাওয়ায় হিট শকে হাওড়াঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বোরো ধানে চিটা হওয়ায় ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া আম, লিচু, কাঁঠাল, জাম, জামরুলসহ সব ধরনের ফল ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে আম ও লিচু ঝরে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। এ পরিস্থিতিতে কৃষকের জন্য কৃষিবিদদের পরামর্শ হচ্ছে-ধান, আম, লিচু, কাঁঠাল, জাম, জামরুলসহ ফলের গাছের গোড়ায় পানি দিতে হবে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে কৃষিবিদরা বলছেন, দাবদাহে বোরো ধানসহ অন্যান্য ফসলও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বর্তমানে পোকামাকড় ও রোগবালাই তেমন না থাকলেও দীর্ঘমাত্রায় তাপপ্রবাহে ধান নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে গেলে ধানে চিটা ধরার আশঙ্কা থাকে। এ অবস্থায় ধানে ফুল অবস্থায় পানি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ধানগাছের গোড়ায় সর্বদা ২ থেকে ৩ ইঞ্চি পানি ধরে রাখা দরকার।


বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে ব্রি (বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট) কৃষককে নানা পরামর্শ দিয়েছে। কাইচ থোড় থেকে শক্ত দানা অবস্থায় থাকা ধানগাছে তাপপ্রবাহ থেকে রক্ষার জন্য জমিতে সর্বদা ৫-৭ সেন্টিমিটার পানি ধরে রাখতে হবে। এ সময় জমিতে যেন পানির ঘাটতি না হয়। এ সময় ধানের শিষ ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ হতে পারে। রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার আগেই প্রিভেনটিভ হিসাবে বিকালে ট্রপার ৮ গ্রাম ১০ লিটার পানি অথবা নেটিভো ৬ গ্রাম ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে পাঁচদিন ব্যবধানে দুইবার স্প্রে করতে হবে। ধানে বিএলবি ও বিএলএস রোগ ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ৬০ গ্রাম থিওভিট, ৬০ গ্রাম পটাশ ও ২০ গ্রাম জিংক ১০ লিটার পানিতে সমানভাবে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে।


কৃষিবিদদের পরামর্শ-ফলজাতীয় সবজি যেমন: বেগুন, টমেটো, মরিচ, মিষ্টিমরিচ, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, করলা, ঝিঙা, চিচিঙ্গা, পটোল, শসা ও ঢ্যাঁড়শখেতে তিন-চারদিন পরপর সেচ প্রয়োগ করতে হবে। অন্যদিকে পাতাজাতীয় সবজি যেমন: ডাঁটা, লালশাক, পুঁইশাক, কলমি, লাউশাক প্রভৃতি খেতে দুই-তিনদিন পরপর সেচ প্রয়োগ করতে হবে। দাবদাহ কমলেও সবজি গাছের ফল সংগ্রহ শেষ হওয়া পর্যন্ত পাঁচ-সাতদিন পরপর সেচ অব্যাহত রাখতে হবে। এতে ফলন বাড়বে। মাটিতে পর্যাপ্ত রস ধরে রাখার জন্য সেচের পর গাছের গোড়ায় মালচিং করতেও পরামর্শ দিয়েছেন তারা।


গবেষকরা বলছেন, মাটির বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে আমগাছে ৭-১০ দিন পরপর সেচ প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া অন্যান্য ফল যেমন লিচু, জামরুল, জাম, কাঁঠাল প্রভৃতি গাছেও ৭-১০ দিন অন্তর সেচ দেওয়া প্রয়োজন। বেসিন পদ্ধতিতে (গাছের চারপাশে রিং তৈরি) সেচ দেওয়া উত্তম। প্লাবন পদ্ধতিতেও সেচ দেওয়া যাবে। দাবদাহ কমলেও ফল পরিপক্ব হওয়া পর্যন্ত ১৫ দিন অন্তর সেচ অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। এতে ফল ঝরে পড়া কমবে এবং ফলন বৃদ্ধি পাবে, বলছেন তারা।


কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইংয়ের পরিচালক কেজেএম আব্দুল আওয়াল যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের তাপমাত্রা প্রতিবছর এপ্রিলে হয়। এ বছর হয়তো ৩/৪ ডিগ্রি বেশি হয়েছে। ব্যক্তি উদ্যোগে যারা আম ও লিচুর বাগান করেছেন, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। কারণ, তারা পানি সরবরাহের ব্যবস্থা রাখেননি। কিন্তু যারা বাণিজ্যিকভাবে আম ও লিচু উৎপাদন করেছেন, তাদের ক্ষতির আশঙ্কা এখন পর্যন্ত নেই।


কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইংয়ের পরিচালক আরও জানান, চলতি বছর আম ৪০ শতাংশ কম হবে। কারণ, শীত দীর্ঘায়িত হওয়ায় ফুল আসতে দেরি হয়েছে। আবার একধরনের ক্ষতিকর পোকা আমের ফুল নষ্ট করেছে। তবে দাবদাহের চেয়ে শীত দীর্ঘায়িত হওয়ায় আম ফসল কম হবে।


এদিকে দাবদাহে কোন ফসল ঝুঁকিতে পড়বে না-এমন প্রশ্নে কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন আধপাকা ধানের জমিতে খুব বেশি পানি লাগবে না। ধানের জমি ভেজা থাকলেই চলবে। কারণ, এখন ধান বের হচ্ছে। দিনদিন তা পরিপক্ব হবে। শুরুতে যে পরিমাণ পানির প্রয়োজন ছিল, এখন সেই পরিমাণ না দিলেও চলবে। তবে প্রতিদিনই ধানগাছের গোড়ায় পানি থাকতে হবে। গাছের গোড়া শুকিয়ে গেলে আর্দ্রতার অভাবে ধান চিটা হয়ে যাবে। ফলে উৎপাদন কমে যাবে।


কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে ফিল্ড সার্ভিসের পরিচালক (সরেজমিন) মো. তাজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, তীব্র দাবদাহে ধানের ফসল দ্রুত পাকতে শুরু করেছে। ধান কাটা, ফসল আহরণে চলতি আবহাওয়া সহায়ক। এক প্রশ্নের জবাবে পরিচালক তাজুল ইসলাম জানান, বরেন্দ্র অঞ্চলের চারটি জেলায় পানি সংকট ছিল। পানির পাম্পগুলো চালু করায় সেই সংকট কাটতে শুরু হয়েছে।


বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহ জাহান কবির যুগান্তরকে বলেন, পানির অভাবে ধান চিটা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে কৃষক যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তেমনই দেশের ক্ষতি হয়ে যাবে।


প্রসঙ্গত, যশোর, চুয়াডাঙ্গাসহ দেশের কোথাও কোথাও তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেছে। গড়ে তাপমাত্রা প্রায় ৩৯ ডিগ্রি। আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্র বলছে, পুরো এপ্রিলেই থাকবে এ তাপপ্রবাহ। একই সঙ্গে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনাও কম।



  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার