বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ: ঋণের বিলম্বে ঝুলছে প্রকল্প


, আপডেট করা হয়েছে : 13-05-2024

বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ: ঋণের বিলম্বে ঝুলছে প্রকল্প

জমি অধিগ্রহণ, ঠিকাদার নিয়োগ—কিছুই হয়নি। অথচ প্রকল্পের সময় কেটে গেছে পৌনে ছয় বছর। এই হাল বগুড়া-সিরাজগঞ্জ ডুয়েলগেজ রেলপথ প্রকল্পের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারতীয় ঋণ না আসায় প্রকল্প থমকে আছে।


ঋণছাড়ের সময়সীমা এখনো নিশ্চিত না থাকায় প্রকল্প কবে শেষ হবে, তা নিয়েও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। কারণ, ৫ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পের ৩ হাজার ১৪৬ কোটি টাকাই ঋণ হিসেবে দেবে ভারত। বাকি ২ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার।


প্রকল্প সূত্র বলছে, পরামর্শক পর্যায়ের কাজ সম্পন্ন। জমি অধিগ্রহণের জন্য ভূমিমালিকদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। জানতে চাইলে গতকাল রোববার রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মো. ইয়াসীন আজকের পত্রিকাকে বলেন, নকশা জটিলতার কারণে অনেক সময় লেগেছে। ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে প্রকল্প শেষ হবে বলে তাঁরা আশাবাদী।


বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জের দূরত্ব মাত্র ৭২ কিলোমিটার হলেও জেলা দুটির মধ্যে সরাসরি রেলপথ নেই। এ কারণে ঢাকা থেকে বগুড়া যেতে ১১২ কিলোমিটার পথ বেশি ঘুরতে হয়। বর্তমানে সিরাজগঞ্জ থেকে বগুড়া যেতে হয় পাবনার ঈশ্বরদী ও নাটোর হয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালে বগুড়ায় এক জনসভায় জেলাটির সঙ্গে সিরাজগঞ্জের সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপনের ঘোষণা দেন।


২০১৭ সালে ভারতের তৃতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় বগুড়া-সিরাজগঞ্জ ডুয়েলগেজ রেলপথ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৮ সালের ১ আগস্ট থেকে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। তবে অগ্রগতি না হওয়ায় এক বছর বাড়িয়ে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত করা হয়। পরে সময় আরও বাড়িয়ে ২০২৬ সাল পর্যন্ত করা হয়েছে।


প্রকল্পে সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশন থেকে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার রানীরহাট পর্যন্ত ৮৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ হবে। এর মধ্যে বগুড়া স্টেশন থেকে শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশনের দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার। রানীরহাট স্টেশন থেকে কাহালু স্টেশনের দূরত্ব ১১ দশমিক ৫ কিলোমিটার। রেলওয়ে বলছে, রেললাইন ছাড়াও ১৬ কিলোমিটার লুপ লাইন এবং বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত নতুন আটটি রেলস্টেশন নির্মাণ করা হবে। এগুলো হলো সদানন্দপুর, কৃষাণদিয়া, রায়গঞ্জ, চান্দাইকোনা, শেরপুর, আড়িয়াবাজার, রানীরহাট ও কাহালু। এর মধ্যে রানীরহাট ও কাহালুতে জংশন হবে। এই রেলপথ হলে বছরে কয়েক কোটি টাকার জ্বালানি সাশ্রয় হবে।


প্রকল্প সূত্র জানায়, প্রকল্পে এখন পর্যন্ত নকশা ও পরামর্শককাজ সম্পন্ন হয়েছে। এ কাজে এবং পৌনে ছয় বছরে প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় হয়েছে প্রায় ২৮ কোটি টাকা। ভূমি অধিগ্রহণের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বগুড়া অংশে যৌথ তদন্ত শেষ হয়েছে। ভারতীয় ঋণ না আসায় ছয় মাস ধরে প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বসে আছেন।


সূত্র বলছে, এলওসির আওতাভুক্ত হওয়ায় প্রাথমিক ঠিকাদার নির্বাচন করবে ভারতের ঋণদাতা এক্সিম ব্যাংক। ওই ব্যাংক ঠিকাদারদের সংক্ষিপ্ত তালিকা দিলে দরপত্র আহ্বান করবে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এ জন্য গত বছর অক্টোবরে ঠিকাদারদের সংক্ষিপ্ত তালিকার জন্য ভারতকে চিঠি দেওয়া হলেও এখনো জবাব আসেনি। ফলে প্রকল্পটি কবে শেষ হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।


এই রেলপথের জন্য মোট ৯৬০ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। এ জন্য প্রকল্পে ১ হাজার ৯২১ কোটি টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে। সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা নুসরাত জাহান বলেন, সিরাজগঞ্জে ৪৬৭ একর ভূমি অধিগ্রহণের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর অংশ হিসেবে ভূমিমালিকদের আপত্তি আছে কি না, তা জানতে ৪ ধারায় নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এরপর আরও দুটি নোটিশ দেওয়া হবে।


বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আফসানা ইয়াসমিন বলেন, বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথের জন্য বগুড়া অংশে ৪৭৯ দশমিক ১৫ একর ভূমি অধিগ্রহণের জন্য গত ফেব্রুয়ারিতে ভূমিমালিকদের ৪ ধারায় নোটিশ দেওয়া হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভূমিমালিকদের আপত্তি গ্রহণ করা হয়েছে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে যৌথ তদন্ত শুরু হয়েছে। বগুড়া অংশের ৫৬ মৌজার মধ্যে ১৪টিতে যৌথ তদন্ত শেষ হয়েছে।


একটি সূত্র বলেছে, ২০২৬ সালেও প্রকল্প শেষ করা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সময় বাড়ায় প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়বে। ব্যয় আরও প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বেড়ে যেতে পারে।


অগ্রগতি জানতে চাইলে বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম ফিরোজী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ভূমি অধিগ্রহণ মাঝামাঝি পর্যায়ে রয়েছে। আগামী অর্থবছরের মধ্যে টাকা পেলে জমি প্রস্তুত হয়ে যাবে। সব ধরনের কাগজপত্র ভারতের এক্সিম ব্যাংককে পাঠানো আছে। ঋণছাড় হলে ঠিকাদার নিয়োগপ্রক্রিয়া চূড়ান্ত হবে। তিনি বলেন, ঋণছাড় হয়তো প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৬ সাল পর্যন্ত করা হয়েছে।


বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, এমন একটি লাভজনক প্রকল্প এত দিন ঝুলে থাকা ঠিক নয়। ঋণছাড় একটি প্রতিশ্রুতি ও দর-কষাকষির ব্যাপার। সময়মতো প্রতিশ্রুতি না রাখলে সরকারের বিকল্প ভাবা উচিত।



  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার