আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস: নিদর্শন পড়ে আছে অযত্ন-অবহেলায়


, আপডেট করা হয়েছে : 18-05-2024

আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস: নিদর্শন পড়ে আছে অযত্ন-অবহেলায়

৪৪ ফুট দীর্ঘ তিমিটি কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত থেকে প্রায় ৩০ মাইল দূরে শোয়ানখালী চরে আটকা পড়েছিল ১৯৮৫ সালে। সেই তিমির কঙ্কাল পরে এনে রাখা হয় জাতীয় জাদুঘরে। দর্শনার্থীরা চাইলেই সেটি ছুঁয়ে দেখতে পারেন। কারণ, অন্য অনেক নিদর্শন কাচের আবরণে ঢাকা থাকলেও তিমির কঙ্কালটি অনাবৃত। ফলে ধুলাবালুর আস্তর জমেছে কঙ্কালের গায়ে।


জাতীয় জাদুঘর দেশের ঐতিহ্য প্রদর্শনীর মাধ্যমে জাতির মানসিক বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধন করবে—এমনটিই ছিল প্রত্যাশা। কিন্তু শত বছরের এই প্রতিষ্ঠান যেন নিজেই বুড়িয়ে গেছে! প্রদর্শনীর জন্য রাখা নিদর্শনগুলোর অযত্ন, অবহেলা তেমন ইঙ্গিতই দেয়। জাদুঘর ব্যবস্থাপনা ও প্রদর্শনী নিয়ে অভিযোগ বিস্তর। বিশ্ব অনেক এগিয়ে গেলেও জাতীয় জাদুঘর চলছে সেই সনাতনি ব্যবস্থাপনায়।


গতকাল শুক্রবার জাদুঘরে গিয়ে দেখা যায়, ভাস্কর্য-২ গ্যালারিতে দ্বিতীয় থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর হিন্দু ও জৈন ভাস্কর্য। কিন্তু ভাস্কর্যগুলোর উপস্থাপন সাদামাটা। সাধারণ একটি বাক্সের ওপর দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে রাখা হয়েছে প্রত্নসম্পদগুলো। খোলা জায়গায় থাকায় গায়ে ধুলা জমেছে। দর্শনার্থীরা হাঁটছেন যে মেঝেতে, সেখানে কোনো পাটাতন ছাড়াই রাখা নবম শতাব্দীর একটি কালো পাথরের শিবলিঙ্গ। সেটি ভাঙা, তাই বেঁধে রাখা হয়েছে সাধারণ একটি তার দিয়ে।


এ রকমই বিভিন্ন গ্যালারিতে চোখে পড়ে অযত্নের ছাপ। একটি পুরোনো হুঁকায় ধুলার আস্তরণ। গ্যালারিতে অনেক নৌকায়ও জমেছে ধুলাবালু। সাধারণত এসব নিদর্শন একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখতে হয়। অনেক গ্যালারিতে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র থাকলেও সেগুলো বিকল হয়ে আছে। বন্ধুকে নিয়ে জাদুঘর দেখতে এসে প্রকৌশলী আবির হোসেন ঘেমে ভিজে গেছেন। তিনি বললেন, ‘খুব অস্বস্তি লাগছে। একে তো গরম, আবার ছুটির দিন বলে লোকজনও বেশি। অনেক গ্যালারির এসি বন্ধ। আমি দর্শনার্থী খাতায় অভিযোগ দিয়ে যাব।’


নিদর্শন ব্যবস্থাপনাও তেমন গোছানো নয়। কোনো কোনো নিদর্শনের শুধু নাম ও প্রাপ্তিস্থান লেখা। এক দর্শনার্থী বললেন, বিস্তারিত বর্ণনা থাকলে ভালো হতো। বস্ত্র ও পোশাক-পরিচ্ছদ গ্যালারিতে একটি বর্ণনা পড়ছিলেন এক বিদেশি। সেখানে বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্প নিয়ে লেখা—জামদানি, টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি, মসলিন, কাতান, বেনারসি ইত্যাদি। বর্ণনা লেখা সাধারণ একটি পিভিসি ব্যানারে। সেটিও অযত্নে ফেলে রাখা।


জাদুঘরের বাইরে কথা হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাকসুদুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘আমাদের জাতীয় জাদুঘরে আমরা দেশের ঐতিহ্য দেখতে আসি। কিন্তু এর উপস্থাপনা এখনো সেকেলে। সাধারণত যারা একেবারেই বিনোদনের জন্য আসে, তারা আনন্দ পায়। কিন্তু যারা একটু বিশদ জানতে চায়, বুঝতে চায়, তারা বিরক্ত হয়। কারণ, এখানে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে কোনো কিছু সাজানো হয়নি—না তথ্য, না নিদর্শন।’ তিনি আরও বলেন, বিশ্ব এখন অনেক এগিয়ে। প্রযুক্তির উন্নয়নে সব কিছুই অসাধারণভাবে উপস্থাপন করা যায়। মানুষ যাতে আকৃষ্ট হতে পারে, সেদিকে কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া দরকার।


এ বিষয়ে জাদুঘর কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, নির্দিষ্ট গ্যালারির দায়িত্বে থাকে নির্দিষ্ট বিভাগ। কোনো নিদর্শন কীভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা সেই বিভাগই ভালো বলতে পারবে। তিমির কঙ্কাল প্রসঙ্গে প্রাকৃতিক ইতিহাস বিভাগের কিপার ড. সুমনা আফরোজ জানান, বিষয়টি তাঁদের নজরে এসেছে। তাঁরা শিগগির এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন।


ইতিহাস ও ধ্রুপদি শিল্পকলা বিভাগের কিপার মোহাম্মদ মনিরুল হক জানান, ছোট ভাস্কর্যগুলো চুরি হওয়ার ভয় থাকায় গ্লাস-ঘরের মধ্যে থাকে। বড়গুলো থাকে বাইরে। তবে ধুলাবালু জমার বিষয়টি তাঁরা দেখবেন।


আন্তর্জাতিক জাদুঘর পরিষদের (আইকম) বাংলাদেশ জাতীয় কমিটির চেয়ারপারসন এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘জাতীয় জাদুঘরে নিদর্শন দেখে দেশের ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। এই সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অন্যতম নিদর্শন হলো মৃৎপাত্র। সেগুলো কয়টি আছে জাদুঘরে? আড়াই হাজার বছরের উয়ারি-বটেশ্বর সময়ের কোনো মৃৎপাত্র আছে? এগুলো ভাবতে হবে।  এখানে জাদুঘর বিশেষজ্ঞ থাকতে হবে। তা কি আছে? এতে বোঝা যায়, ব্যবস্থাপনার ঘাটতিটা কোথায়। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে এটি বুঝতে হবে।’ তিনি জাদুঘরের কাঠামোতে পরিবর্তন আনার তাগিদ দেন।



  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার