ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলতে বাধা নেই


, আপডেট করা হয়েছে : 21-05-2024

ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলতে বাধা নেই

নিষেধাজ্ঞার পর দুদিনের বিক্ষোভের মধ্যে রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলতে বাধা নেই বলে জানিয়েছে সরকার। তবে তিন চাকার যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ থাকা দেশের গুরুত্বপূর্ণ ২২ মহাসড়কে এটি চলবে না। গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে নির্দেশনা দেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নীতিমালার মাধ্যমে বিজ্ঞানসম্মতভাবে অল্প টাকায় বিদ্যুৎচালিত অটোরিকশা তৈরি সম্ভব। এতে সড়ক নিরাপত্তা বাড়াবে।


বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের আনুমানিক হিসাব বলছে, ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাটারিচালিত রিকশা সাত লাখের বেশি। রাজধানীতে চলছে প্রায় ৮০ হাজার। দেশজুড়ে প্রায় ৩০ ধরনের ব্যাটারিচালিত অনুমোদনহীন যানবাহন চলছে। মহাসড়কসহ সব ধরনের পথেই দাবড়ে বেড়াচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ এসব যান। ফলে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা। এরই মধ্যে অনুমোদনহীন এসব যানবাহন রাজধানীতে চলাচলের ফের অনুমতি পেল। এই প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ব্যাটারিচালিত যানবাহন তৈরির চিন্তা করছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া নির্দেশনা দ্রুতই বিআরটিএতে পাঠানো হবে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।


যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না করে হঠাৎ ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ হলে বেকারত্ব বাড়বে। এই সেক্টরের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৩০ লাখ মানুষ পথে বসবে। এমন বাস্তবতায় অনুমোদনহীন যানবাহনের পার্টস আমদানি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে নিষিদ্ধ করে উৎপাদন বন্ধের তাগিদ দিয়েছেন তারা। সেইসঙ্গে বিকল্প হিসেবে ব্যাটারিচালিত রিকশা বিআরটিএর মাধ্যমে অনুমোদনের পরামর্শ তাদের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা ব্যয় করলেই বর্তমান রিকশাগুলোকে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে বৈদ্যুতিক গাড়িতে রূপান্তর সম্ভব। এতে অবৈধ এসব যানবাহন চলাচলের নামে চাঁদাবাজি কমবে। বিআরটিএর রেজিস্ট্রেশনের মধ্য দিয়ে বাড়বে সরকারের রাজস্ব।


নীতিমালা করে এসব যানবাহন চলাচলের বৈধতা দেওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ব্যাটারিচালিত রিকশার বৈধতা দেওয়া মানেই এগুলো কোনো মহাসড়কে চলতে পারবে না।


ব্যাটারিচালিত রিকশার বিকল্প বাহনের কোনো চিন্তা আছে কি না—জানতে চাইলে সড়ক সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী কালবেলাকে বলেন, এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন। আমাদের মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীও ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে কথা বলেছেন। এই বাহন নিয়ে বিকল্প চিন্তার কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশ দিয়েছেন, তা বাস্তবায়ন হবে।


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি পরিকল্পিত শহরের জন্য প্রয়োজন ২৫ ভাগ সড়ক। রাজধানীতে আছে সর্বোচ্চ ৮ ভাগ। এর মধ্যে গণপরিবহন চলাচলের উপযোগী পথ সর্বোচ্চ আড়াই ভাগ। সরকারের দুর্বল কৌশলের কারণে গণপরিবহন চলাচলের উপযোগী রাস্তা কম। তা ছাড়া স্মার্ট নগরীতে এখন আর প্যাডেলচালিত রিকশা থাকা উচিত নয়। ব্যাটারিচালিত গাড়ি অনুমোদন দেওয়ার পর সেগুলো যেন কোনোভাবেই নগরীর প্রধান বা গুরুত্বপূর্ণ সড়কে চলতে না পারে, এ ব্যাপারে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।


গত ১৫ মে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম বৈঠকে সড়কে শৃঙ্খলা আনতে রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে অভিযানে নামে পুলিশ। এর প্রতিবাদে গত রোববার রাজধানীর মিরপুরে দিনভর সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন অটোরিকশার চালকরা। তারা পুলিশ বক্সে অগ্নিসংযোগও করেন। এর বাইরে নগরীর একাধিক স্থানে চালকরা বিক্ষোভ করেন।


ঢাকায় চলাচলের অনুমতি: নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে দুদিন বিক্ষোভের পর শুধু ঢাকা সিটি এলাকায় ব্যাটারিচালিত যানবাহন চলাচলের অনুমতি দেওয়ার কথা বললেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বরাত দিয়ে তিনি জানান, বিশ্ব পরিস্থিতি ও উচ্চ দ্রব্যমূল্যের এ সময়ে স্বল্পআয়ের মানুষের কষ্টের কথা বিবেচনা করে শুধু ঢাকা শহরে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের অনুমতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে ২২টি মহাসড়কে আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল বন্ধ থাকবে।


গতকাল রাজধানীতে এ অনুষ্ঠানে তিনি আরও বলেন, আমরা নতুন নীতিমালা নিয়ে আসছি।


বিআরটিএকে বলেছি, ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকদের প্রতিনিধিদের ডাকুন, কথা বলুন। চালকদের ট্রেনিং, গাড়ির সাইজ একটা নিয়মের মধ্যে আনতে হবে। গাড়ির সাইজ, চাকা এগুলো যেন বাস্তবসম্মত হয়। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা সবাইকে বিআরটিএ পৌঁছে দেবে এবং কার্যকর ব্যবস্থা নেবে।


এদিকে ‘রিকশা, ব্যাটারি রিকশা-ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদ’ গতকাল ৭ দফা দাবি জানিয়েছে। থ্রি-হুইলার ও সমজাতীয় মোটরযান নীতিমালা চূড়ান্ত ও কার্যকর করে ইজিবাইক, রিকশাসহ ব্যাটারিচালিত যানবাহনের দ্রুত নিবন্ধন, লাইসেন্স প্রদান ও রুট পারমিটের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। দাবি আদায় না হলে ২৭ মে সারা দেশে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন নেতারা। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গতকাল বিক্ষোভ সমাবেশ করে সংগঠনটি।


এক জরিপের বরাত দিয়ে সংগ্রাম পরিষদ নেতারা বলেন, মহানগরীর প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ এ ধরনের যানবাহনে চলাচল করে। আর ৬ শতাংশ যাত্রী নিয়ে রাজধানীর প্রায় ৮০ শতাংশ রাস্তা দখল করে যানজট সৃষ্টি করে প্রাইভেট গাড়ি। এই বাহনের সঙ্গে চালক, মালিক, মহাজন, গ্যারেজ মালিক, চার্জিং ব্যবসায়ী, শ্রমিক মেস পরিচালনাকারী ও মোটর-রিকশা পার্টস, ব্যাটারিসহ সারা দেশে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ জড়িত। ঢাকা মহানগরে এ সংখ্যা আনুমানিক ৫ লাখের ওপরে। নেতারা বলেন, বিআরটিএর বিজ্ঞপ্তিতে এই যানবাহন বন্ধের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ‘মোটর ভেহিক্যাল অ্যাক্ট ২০১৮’ অনুযায়ী এটি অনুমোদিত নয়। কিন্তু এরই মধ্যে ইলেকট্রিক মোটরযান চলাচল সংক্রান্ত নীতিমালা পাস হয়েছে এবং ইজিবাইক, রিকশাসহ ব্যাটারিচালিত থ্রি-হুইলার মোটরযান নীতিমালা চূড়ান্ত হওয়ার পথে। ব্যাটারিচালিত যানবাহন এই নীতিমালার অন্তর্ভুক্ত। ফলে মোটর ভেহিক্যাল অ্যাক্ট এখানে প্রযোজ্য নয়।


বুয়েটের অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. হাদীউজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা কোনোভাবেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। এজন্য বিদ্যুৎচালিত রিকশায় আমাদের যেতে হবে। বিদ্যমান রিকশাগুলোতে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা ব্যয় করলেই দেশীয় প্রযুক্তিতে বিজ্ঞানসম্মতভাবে নিরাপদ বাহনে রূপান্তর সম্ভব। এতে সব ধরনের ঝুঁকি কমবে। তবে একটি নীতিমালার মধ্য দিয়ে তা করতে হবে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও মহাসড়কে কোনোভাবেই এসব যানবাহন চলতে দেওয়া যাবে না।


যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাঈদুর রহমান বলেন, ফিজিবিলিটি স্টাডি না করে অনুমোদনহীন যানবাহন আকস্মিকভাবে বন্ধ করা ঠিক হয়নি। এতে এ খাতে যুক্ত মানুষের বিপদ বাড়বে। তারা পথে বসবেন। কীভাবে এসব যানবাহন সারা দেশে ছেয়ে গেল এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, নিষিদ্ধ যানের উৎপাদন আগে বন্ধ করতে হবে। এলসির মাধ্যমে পার্টস আমদানি বন্ধ না হলে বিপজ্জনক এসব যানবাহন আরও বাড়বে।



  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার