‘নেই কাজ তো খই ভাজ’-বহুল প্রচলিত এই প্রবাদটি এখন ঢাকাই সিনেমার গুটিকতক নায়িকার জন্য প্রযোজ্য। সম্প্রতি কয়েকজন নায়িকার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে বেশ উত্তাল সিনেমাপাড়া। বইছে সমালোচনার ঝড়। নিজেদের মধ্যে কাদা ছোঁড়াছুড়ি, প্রযোজকের ফ্ল্যাট-গাড়ি ভোগ, সিনেমা থেকে বাদ পড়া, পরিচালককে মারধর- এরকম নানান ঘটনায় উঠে এসেছে নায়িকাদের নাম। তাদের এহেন কর্মকাণ্ডে বিরক্ত ও বিব্রত সিনেমার অগ্রজ শিল্পীরা।
ঢাকাই সিনেমায় বিদেশি নায়িকার আনাগোনা, বেকার দেশের শিল্পীরা- এমনটা দাবি করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘আমাদের দেশের নায়িকারা বেকার বসে আছেন, এদিকে বিদেশি নায়িকা নিয়ে এসে করানো হচ্ছে সিনেমা। কাজ না থাকায় বেকার মস্তিস্কে শয়তান ভর করে, এমনটাই স্বাভাবিক। কাজ না থাকায় নায়িকারা যে যার মতো করে ইস্যু তৈরি করে আলোচনায় থাকার চেষ্টা করছেন। তাতে করে যে পুরো সিনেমা শিল্প সমালোচিত হচ্ছে, তা তাদের বোধগম্য হচ্ছে না।’
সম্প্রতি নায়িকাকাণ্ডে নাম উঠে এসেছে অপু বিশ্বাস, শবনম বুবলী, মাহিয়া মাহি, ইয়ামিন হক ববির নাম। তাদের কর্মকাণ্ডে সিনেমার শিল্পীদের নিয়ে হাসাহাসি করছে সাধারণ মানুষ। শিল্পীদের কতটা সংবেদনশীল হতে হয় তা হয়তো ভুলেই গেছেন এই শিল্পীরা।
শাকিব ইস্যুতে ফের দ্বন্দ্বে জড়ালেন অপু-বুবলী
অপু বিশ্বাস ও শবনম বুবলী- দু’জনেই নিজেদের শাকিব খানের স্ত্রী দাবি করেন। যদিও শাকিব খান তা এখন আর মানতে নারাজ। দু’জনকেই তিনি তালাক দিয়েছেন। অথচ এই শাকিবকে নিয়েই নিজেদের মধ্যে প্রতিনিয়ত চলে তাদের খোঁচাখুঁচি। কে কাকে অপমান করবেন- এ নিয়েই চলে নিত্য প্রতিযোগিতা।
এই ঈদেই মুক্তি পায় বুবলীর সিনেমা ‘রিভেঞ্জ’। তবে মুক্তির পর দর্শক খরায় পড়ে সিনেমাটি। নানা অভিযোগে পরিচালক ইকবাল তার পরবর্তী সিনেমা ‘বিট্রে’ থেকে বাদ দেন বুবলীকে। তবে এ প্রসঙ্গে বুবলী তার অবস্থান পরিষ্কার করে জানান, ‘সিনেমা থেকে আমাকে বাদ দেওয়ার কিছু নেই। আমি নিজেই এ সিনেমা থেকে তিন বছর আগে সরে এসেছি। এছাড়াও আমার স্বামীকে (শাকিব খান) নিয়ে কেউ যদি বাজে মন্তব্য করে আমি তো তাকে এড়িয়ে চলব, এটাই স্বাভাবিক।’
বুবলীর এমন মন্তব্যে চটলেন অপু বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘আজ বুবলী এতো স্বামী দরদী হয়ে গেল! কিছু দিন আগেও যখন আফরান নিশো (অভিনেতা) শাকিবকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করলেন, তখন তার এই ভালোবাসা কোথায় ছিল? এখন আত্মরক্ষা করার জন্য শাকিবের নাম ব্যবহার করছে।’
এক শাকিবকে নিয়ে এই দুই নায়িকার টানাটানি সিনেমাশিল্পের প্রতি মানুষের সম্মানবোধ কমিয়ে দিচ্ছে বলেই বিশিষ্টদের অভিমত।
প্রযোজকের উপহার নিয়ে সমালোচিত মাহিয়া মাহি
জাজ মাল্টিমিডিয়ার হাত ধরে শোবিজে আসেন চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার আব্দুল আজিজ প্রকাশ্যে বলেন, মাহিকে তিনি উপহার হিসেবে গাড়ি-ফ্ল্যাট দিয়েছেন। আর তাতেই শুরু হয় গুঞ্জন।
এ প্রসঙ্গে মাহিয়া মাহি বলেন, ‘আজিজ ভাই থেকে শুরু করে পুরো জাজ মাল্টিমিডিয়া, তারা আমাকে আজকের মাহিয়া মাহি বানিয়েছে। সুতরাং ফ্ল্যাট, গাড়ি এগুলো তো অনেক ক্ষুদ্র বিষয়। তারা যদি এটা বলে থাকে, আমি এ নিয়ে কোনো কিছু বলব না। আমার কাছে জাজকে অনেক সম্মানের একটা জায়গায় রেখেছি, আজীবন রাখব। আমি যেহেতু সম্মান করি, সেই সম্মানটা আমিও তাদের কাছ থেকে চাইব।’
তবে নায়িকারা যে সিনেমার সম্মানির বাইরেও প্রযোজকের কাছ থেকে আলাদা কিছু উপহার হিসাবে পান, সেটাও প্রকাশ্যে আসায় সমালোচনা চলছে সিনেমা অঙ্গনের মানুষদের নিয়ে।
নির্মাতাকে মারলেন ববি
গেল ঈদেই মুক্তি পায় রাশিদ পলাশ নির্মিত সিনেমা ‘ময়ুরাক্ষী’। সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন ইয়ামিন হক ববি। সিনেমাটি নামমাত্র প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়ায় সেভাবে আলোচনায় আসেনি। আর তাতেই ক্ষুব্ধ নায়িকা। এছাড়াও আরও নানান অভিযোগে নায়িকা হাত তুললেন নির্মাতার গায়ে। যা সিনেমা পাড়ায় সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
নায়িকার অভিযোগ, এই সিনেমায় তাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়নি। গল্প পরিবর্তন করা হয়েছে। অনেক দৃশ্য কেটে ফেলা হয়েছে। এছাড়াও আরও নানান অভিযোগ রয়েছে।
তবে এ ব্যাপারে নির্মাতা রাশিদ পলাশ বলেন, ‘আমাদের মধ্যে বন্ধুর সম্পর্ক, তাই এই হাতাহাতির ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রায়ই হয়। এটাকে অন্যভাবে নেওয়ার কিছু নাই।’
নায়িকাদের এসব কাণ্ডে সাধারণ দর্শকদের কাছে সিনেমার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে বলেই মনে করছেন সিনেমা সংশ্লিষ্টরা।
ক্ষোভ প্রকাশ করে বর্ষীয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝন্টু বলেন, ‘মযূরাক্ষীর ক্ষেত্রে বলব, নির্মাতা ও নায়িকা দুজনেই অপরাধ করেছে। প্রযোজক যদি পরিচালককে টাকা দিয়ে থাকে, আর সে যদি শিল্পীদের না দেয়, তাহলে এটা অপরাধ করেছে। এদিকে শিল্পী পরিচালকের গায়ে হাত তুলেছে এটাও অপরাধ। তাদের এই কর্মকাণ্ডের জন্য সিনেমা শিল্পীদের নিয়ে মানুষ হাসাহাসি করে। তারা সিনেমার ভালো চায় না। যদি তাই চাইতো তাহলে তারা সিনিয়র শিল্পীদের দেখে শিখত। নিজেদের মধ্যে এরকম মারামারি করে লোক হাসাতো না ও সিনেমার শিল্পীদের এভাবে দেশের মানুষের কাছে ছোট করত না।’
নায়িকাদের এসব বিতর্কিত কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি ও চিত্রপরিচালক কাজী হায়াত বলেন, ‘শুধু সিনেমায় নয়, সমাজের প্রত্যেকটি জায়গাতেই অনেক কিছুই হয়। কিন্তু ফোকাস হয় সিনেমা। তবে নায়িকাদের এসব কর্মকাণ্ড সত্যিকার অর্থেই সিনেমার জন্য অমঙ্গলের। সবাইকে এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে।’
এছাড়াও এই কাণ্ডে ক্ষোভ ঝেড়েছেন সিনেমা সংশ্লিষ্ট অনেক নির্মাতা-প্রযোজকসহ সিনিয়র শিল্পীরা। অনেকেই বলছেন, ‘বর্তমান সিনেমার অবস্থা যেমন বাজে, তেমনি শিল্পীদেরও। এখন সিনেমার কাজ কমে গেছে। অনেকেই বেকার বসে আছেন। এখন সিনেমা নিয়ে শিল্পীরা যেমন ভাবেন না, তেমনি তারা নিজেদের নিয়েও ভাবেন না। যদি তারা তাদের মধ্যে শিল্পীর মন মানসিকতা পোষণ করতেন, তাহলে দেশের মানুষের কাছে এই শিল্প তথা শিল্পীদের এভাবে ছোট করতেন না। তাদের এসব কাণ্ডে পুরো দেশ তথা বিশ্বের কাছে আমাদের সিনেমার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।’