সরকারি চাকরির নিয়োগে প্রশ্নফাঁসের ঘটনা সামনে আসার পর চরমভাবে আস্থার সংকটে পড়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। উধ্বর্তন কর্মকর্তাসহ কর্মচারীদের প্রশ্নফাঁসে সংশ্লিষ্টতার কারণে চরমভাবে বিব্রত প্রতিষ্ঠানটি। অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বড় কর্তাদের নামও গোয়েন্দা তদন্তে উঠে আসছে।
এমন পরিস্থিতিতে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছে সাংবিধানিক দপ্তর পিএসসি। চাকরির পাশাপাশি অন্য পেশায় যুক্ত থাকায় পাঁচ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর মনিরুল ইসলামকে কোচিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে শোকজ করা হয়েছে। বাকি চারজনের বিষয়ে তথ্য প্রদানে অস্বীকৃতি জানিয়েছে কমিশন।
সূত্রের দাবি এই চারজনের মধ্যে দুইজন সহকারী পরিচালক পদমর্যাদার ব্যক্তি রয়েছেন। এরই মধ্যে কমিশনের সর্বনি¤œ পদের কর্মচারী থেকে সর্বোচ্চ পদধারী ব্যক্তিকেও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পদের হিসাব চাওয়া হচ্ছে। নেওয়া হচ্ছে গোপন খোঁজখবর। অসামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু পাওয়া গেলেই বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এখন পর্যন্ত প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় পিএসসির ৫ কর্মকর্তা-কর্মচারী কারান্তরীণ রয়েছেন। নতুন করে আরও ৫ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়েছে। সূত্র বলছে আরও কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকে দপ্তরের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হতে পারে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিএসসির একাধিক সদস্য জনকণ্ঠকে জানান, প্রশ্নফাঁসের ঘটনা প্রকাশের পর থেকেই প্রশ্ন প্রণয়ন থেকে ফল প্রকাশ প্রতিটি ধাপে গভীরভাবে তদন্ত করা হচ্ছে। কোনো ধাপে ক্রটি আছে কি না তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
এদিকে বুধ ও বৃহস্পতিবার পিএসসির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যে অনিয়ম পাওয়া গেছে তার একটি চিঠি জনকণ্ঠের হাতে এসেছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, মো. মনিরুল ইসলাম, অফিস সহকারী কাম কম্পি. মুদ্রাক্ষরিক, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন সচিবালয় কোচিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আছেন বলে জানা গেছে। সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯ এর ১৭ বিধিতে উল্লেখ রয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারী সরকারের পূর্বানুমোদন ব্যতিরেকে সরকারি কার্য ব্যতীত অন্য কোনো ব্যবসায়ে জড়িত হতে অথবা অন্য কোনো চাকরি বা কার্য গ্রহণ করতে পারবেন না।’ এমতাবস্থায়, আপনি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত কোচিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়েছেন, যা দাপ্তরিক শৃঙ্খলার পরিপন্থি। এরূপ আচরণের জন্য বিধি অনুযায়ী আপনার বিরুদ্ধে কেন বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না সে বিষয়ে পত্র প্রাপ্তির সাত কর্মদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর জন্য বলা হলো।
পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ইকরাম আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, কর্ম কমিশন শুধুই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নয়। এটি প্রজাতন্ত্রেরও অন্যতম প্রতিষ্ঠান। ফলে এখানকার কর্মরতদের জন্য সরকারি চাকরি আচরণ বিধিমালা রয়েছে। তবে শুধু বিধি দিয়ে আটকে থাকলেই হবে না। এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নীতি নৈতিকতা যে লোপ পেয়েছে তা সাম্প্রতিক ঘটনায় উঠে এসেছে। তাদের ভুলে গেলে চলবে না এখানে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয় তারা দেশের সম্মুখ সিটে বসে দেশ পরিচালনা করবেন। ফলে এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়োগের সময় আরও যাচাই-বাছাই, অতীত রেকর্ড মুখ্য বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
বিসিএসসহ ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (বিপিএসসি) ঊর্ধ্বতন তিন কর্মকর্তাসহ পাঁচজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এরই মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাময়িক বরখাস্ত করেছে পিএসসি। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি। এ পাঁচজন হলেন, উপ-পরিচালক মো. আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির এবং পিএসসির কর্মচারী ডেসপাস রাইডার খলিলুর রহমান ও অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম।
চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ রেলওয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র অবৈধ উপায়ে সংগ্রহ, পরীক্ষার পূর্বে প্রশ্নপত্র প্রকাশ এবং বিতরণ করে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী হিসেবে অপরাধ সংঘটনে জড়িত থাকার অভিযোগে কর্ম কমিশনের পাঁচজনসহ অন্যদের আসামি করে পল্টন থানার মামলা হয়েছে।
এদের মধ্যে ৫ জন কর্মচারী গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে জেলে আছেন। তা ছাড়া, তাদের নিজ নামে ও তাদের পরিবারের সদস্যের নামে অসাধু উপায়ে অর্জিত ও তাদের জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির দখলে রয়েছেন বা মালিকানা অর্জন করেছেন মর্মে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
এভাবে অসাধু উপায়ে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মালিকানা অর্জন দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর তফসিলভুক্ত অপরাধ হওয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক তদন্তপূর্বক উপযুক্ত আদালতে বিচারার্থ মামলা দায়ের করার লক্ষ্যে সাক্ষ্য প্রমাণাদি সংগ্রহের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। তাই এসব অভিযোগ তদন্ত করে কমিশনকে অবহিত করতে অনুরোধ করেছে সংস্থাটি।
পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান এটি আহামেদুল হক চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, এতদিন যে ভুল ত্রুটি অনিয়ম হয়নি এটা বলা যাবে না।
বরং বেশি নিয়ন্ত্রণে ছিল সেটি বলা যেতে পারে। আসল কথা হচ্ছে যতদিন হাতে প্রশ্ন প্রণয়ন হাতে তৈরি হবে, হাতে হাতে হলরুমে পরীক্ষার প্রশ্ন দেওয়া অর্থাৎ পুরো কার্যক্রমটি ম্যানুয়ালি থাকলে এই ধরনের অনিয়ম ও প্রশ্নফাঁস ঠেকানো সম্ভব হবে না। তিনি অভিযোগ করেন, সম্প্রতি একজন পিএসসি সদস্যের কক্ষে প্রশ্নপত্রের ট্যাংক পাওয়া গেছে। বিষয়টি অবাক করার মতো। কারণ প্রশ্নপত্র থাকবে ভল্টে। পিএসসি সদস্যের কক্ষে নয়।
তিনি জানান, ভবিষ্যতে বিসিএস পরীক্ষা অনলাইনে নেওয়া হলে এসব সমস্যা আর দেখা যাবে না। যখন প্রশ্নব্যাংক থাকবে সেখানে ৫০ হাজার প্রশ্নপত্র মজুত রাখা যাবে। অনলাইনে পরীক্ষার জন্য অভিন্ন প্রশ্নপত্রও পরীক্ষার্থীদের দেওয়া যাবে। কারণ চার লাখ প্রার্থীর পরীক্ষায় হাতে খাতা দেখে কখনোই নির্ভুল পরীক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনা সম্ভব হবে না।