বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘদিন দেরির কারণে বাংলাদেশকে কমিটমেন্ট ফি বাবদ লক্ষ লক্ষ ডলার গুনতে হচ্ছে। ঋণদাতাদের কাছ থেকে ছাড় না হওয়া অর্থের জন্য এ মাশুল দিতে হয়।
কমিটমেন্ট ফি এমন একটি চার্জ যা ঋণদাতার কাছ থেকে ক্রেডিট লাইন খোলা রাখতে বা ভবিষ্যতে ঋণের নিশ্চয়তা পেতে ঋণগ্রহীতাকে দিতে হয়।
যেমন, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) ২০১১ সালে পাওয়ার সিস্টেম ইফিসিয়েন্সি ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্পের জন্য ৩০০ মিলিয়ন ডলার অনুমোদন করেছিল, যা ২০১৭ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্পটি চারবার মেয়াদ বাড়িয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ছয় বছরের প্রকল্পটি এখন ১৩ বছর ধরে চলছে।
এর ফলে বাংলাদেশকে ঋণের আকারের ০.৯৪ শতাংশ বা ২.৭৩ মিলিয়ন ডলার কমিটমেন্ট ফি দিতে হবে বলে সাম্প্রতিক এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে জানিয়েছে এডিবি।
এছাড়া, প্রকল্পে দেরির ফলে মুদ্রাস্ফীতি এবং বিনিময় হারের ওঠানামার মতো কারণের জন্য ঋণের খরচ ৩ শতাংশ বেড়েছে। ফলে প্রকৃত ঋণের পরিমাণ কমে ২৯১.৮৭ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছে এডিবি।
বৈশ্বিক ঋণদাতাদের কমিটমেন্ট ফি
এডিবির পাশাপাশি অন্যান্য আন্তর্জাতিক ঋণদাতা গোষ্ঠীগুলোও উন্নয়ন প্রকল্পের ঋণের জন্য কমিটমেন্ট ফি আরোপ করে।
এডিবি সাধারণত ০.১৮ শতাংশ থেকে ১.১৮ শতাংশ পর্যন্ত, এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) ০.২৫ শতাংশ থেকে ০.৫০ শতাংশ পর্যন্ত এবং বিশ্বব্যাংক সাধারণত ০.৫ শতাংশ কমিটমেন্ট ফি ধার্য করে।
কমিটমেন্ট ফি মূলত ঋণের অব্যবহৃত অর্থের একটি নির্দিষ্ট শতাংশ হিসেবে ধার্য করা হয় এবং একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার পরে প্রযোজ্য হয়- যেমন ঋণচুক্তির ৬০ থেকে ৯০ দিন পর। ঋণগ্রহীতার জন্য তহবিল সক্রিয় রাখার দায় হিসেবে ঋণদাতা গোষ্ঠী এ ফি নির্ধারণ করে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যদি প্রকল্প নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করা যায়, তাহলে অতিরিক্ত কমিটমেন্ট ফি দিতে হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে প্রকল্প-বিলম্ব দীর্ঘদিনের সমস্যা, যেখানে পাঁচ বছরের প্রকল্প শেষ করতে প্রায়ই ১০ বছর লেগে যায়।
তিনি আরও বলেন, বাস্তবায়নকারী সংস্থা বা প্রকল্প পরিচালকের অদক্ষতার কারণে বৈদেশিক ঋণের অতিরিক্ত ফি দিতে হচ্ছে।
এডিবি-কে ২৩.৫৪ মিলিয়ন ডলার কমিটমেন্ট ফি
এডিবি বাংলাদেশে ১৫টি অর্ডিনারি ক্যাপিটাল রিসোর্সেস (ওসিআর) ঋণ বিশ্লেষণ করেছে। ওসিআর ঋণগুলো নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর উন্নয়ন প্রকল্পে সহায়তা করার জন্য দেওয়া হয়। ঋণচুক্তির ৬০ দিন পর থেকে কমিটমেন্ট ফি আরোপ করা হয়।
২০২৪ সাল নাগাদ সমাপ্ত বা সমাপ্তির পথে থাকা প্রকল্প ঋণসমূহের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশ মোট ৩.৯৭৯ বিলিয়ন ডলার ঋণের ০.৫৯ শতাংশ বা ২৩.৫৪ মিলিয়ন ডলার কমিটমেন্ট ফি পরিশোধ করেছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকল্পগুলোর ধীরগতিতে বাস্তবায়ন, ধীরে অর্থ ছাড়, এবং দীর্ঘায়িত প্রকল্প মেয়াদ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কমিটমেন্ট ফি সাধারণত নিট ঋণের ০.১৮ শতাংশ থেকে ১.১৮ শতাংশ পর্যন্ত হয়।
উচ্চ কমিটমেন্ট ফি মূলত দীর্ঘ বাস্তবায়ন সময়কাল এবং প্রাথমিক পর্যায়ে কম অর্থ ছাড়ের কারণে হয়ে থাকে। এছাড়াও অনেক প্রকল্প ঋণচুক্তির ৬০ দিনের বেশি সময় পর কার্যকর হয়, যা কমিটমেন্ট ফি বাড়ানোয় ভূমিকা রাখে।
প্রতিবেদনে আরেকটি প্রকল্পের উল্লেখ রয়েছে- সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কোঅপারেশন রেলওয়ে কানেক্টিভিটি উদ্যোগের অধীনে পরিচালিত আখাউড়া-লাকসাম ডাবল ট্র্যাক প্রকল্প। এ প্রকল্পে ঋণ কার্যকর ও বিতরণে ধীরগতির কারণে উচ্চ কমিটমেন্ট ফি ধার্য করা হয়েছে।
২৭৪ মিলিয়ন ডলার নিট ঋণের মধ্যে ৩.২৪ মিলিয়ন ডলার বা ১.১৮ শতাংশ কমিটমেন্ট ফি হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে প্রকল্পটিতে।
অন্যদিকে, সাউথ এশিয়া সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কোঅপারেশন (সাসেক) প্রকল্পের অধীনে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলওয়ে প্রকল্পের প্রথম ধাপে ২১০ মিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য কমিটমেন্ট ফি ছিল ০.৩৭ মিলিয়ন ডলার বা ০.১৮ শতাংশ- যা উন্নত ঋণ কার্যকারিতা এবং বাস্তবায়ন অগ্রগতির কল্যাণে বাকি সব প্রকল্পের তুলনায় সর্বনিম্ন।
প্রকল্পে বিলম্ব যেভাবে খরচ বাড়ায়
এডিবি-এর প্রতিবেদনে বেশ কিছু প্রকল্পের উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে প্রকল্প বাস্তবায়ন দীর্ঘ হওয়ায় খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন, ২০১২ সালে গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের জন্য এডিবি ১৬০ মিলিয়ন ডলার অনুমোদন করেছিল। প্রকল্পটি ২০১৭ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল।
তবে প্রকল্পটি পাঁচ বছর বাড়িয়ে ২০২২ সাল পর্যন্ত চলমান থাকে। এতে মোট ব্যয় ৯৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৪৯৪ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। ফলে অতিরিক্ত খরচ মেটাতে এডিবি-কে ঋণ বাড়িয়ে ২৬০ মিলিয়ন ডলার করতে হয়েছিল।
এডিবির প্রতিবেদনে সময়সীমা ও খরচ বৃদ্ধির কারণগুলোর মধ্যে নির্মাণ ব্যয়ের কম মূল্যায়ন, বাস্তবায়নের মাঝপথে প্রকল্প কাঠামো ও নকশায় পরিবর্তন, জমি অধিগ্রহণ ও ইউটিলিটি স্থানান্তরে বিলম্ব, ঠিকাদারদের ধীরগতি এবং কোভিড-১৯-এর প্রভাবের কথা উল্লেখ রয়েছে।
ঢাকা এনভায়রনমেন্টালি সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই নামক আরেকটি প্রকল্পের জন্য ২০১৩ সালে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের অনুমোদন দেওয়া হয়। সেটিও দেরির মুখে পড়েছে।
প্রকল্পের সমাপ্তির সময়সীমা ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। যার ফলে ২০২২ সালের মে মাসে সমাপ্তির জন্য নির্ধারিত প্যাকেজ ১-এর চুক্তির খরচ ২৪ শতাংশ বাড়ে।
এখন এ প্রকল্পের সমাপ্তি ২০২৫ সালের আগস্টের মধ্যে হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে অতিরিক্ত ৩৯.৭ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে, এবং মূল চুক্তির খরচ ৩৬.৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
এআইআইবি-কে ১১.৫৬ মিলিয়ন এবং বিশ্বব্যাংককে ৫.৭৬ মিলিয়ন ডলার
এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) ২০১৬ সালে ১৬৫ মিলিয়নের প্রকল্প দিয়ে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ শুরু করে। প্রথম তিন বছরে চারটি প্রকল্পে এআইআইবি-এর মোট অর্থায়ন ছিল ৪৪৫ মিলিয়ন ডলার। এখন পর্যন্ত ব্যাংকটি ২৩ প্রকল্পে ৩.৮৫ বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করেছে।
এর মধ্যে ২.০৫ বিলিয়ন ডলারের ১১টি প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে। চলমান ১১টি প্রকল্পে ১.৭৬ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে।
এআইআইবি ০.২৫ শতাংশ থেকে ০.৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমিটমেন্ট ফি ধার্য করে। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ব্যাংকটিকে ১১.৫৬ মিলিয়ন ডলার ফি পরিশোধ করেছে।
বিশ্বব্যাংকের স্কেল-আপ ফ্যাসিলিটি (এসইউএফ) ঋণের জন্যও সাধারণত ০.৫ শতাংশ কমিটমেন্ট ফি দিতে হয় বাংলাদেশকে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রথম বাজারভিত্তিক এ ঋণ নেওয়া হয়।
এখন পর্যন্ত মোট ৯টি এসইউএফ ঋণের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ২.৩৯ বিলিয়ন ডলারের জন্য চুক্তি করেছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ কমিটমেন্ট ফি দিয়েছে ৫.৭৬ মিলিয়ন ডলার।