বিএনপি জামায়াত ও সংখ্যালঘুদের মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা


, আপডেট করা হয়েছে : 27-11-2024

বিএনপি জামায়াত ও সংখ্যালঘুদের মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা

পুলিশের অতিরিক্ত আইজি হিসাবে চাকরি থেকে অবসরে গিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-৩ (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন এম সানাউল হক। কিন্তু হঠাৎ ডাক পড়ে মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক হিসাবে। আইজিপি পদমর্যাদার ওই পদে আসীন হওয়ার পরই রাতারাতি বদলে যায় তার বৈষয়িক অবস্থা। ‘টাকার কুমির’ বনে যান করিমগঞ্জ উপজেলার গুজাদিয়া ইউনিয়নের নামাপাড়া গ্রামের মরহুম সোলায়মান মাস্টারের ছেলে সানাউল হক। এলাকার নিরীহ লোকজন এবং ভিন্নমত ও প্রতিপক্ষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন মূর্তিমান আতঙ্ক হিসাবে। 


বিএনপি-জামায়াত নেতাদের যুদ্ধাপরাধ মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে কামিয়েছেন বিপুল অর্থ। ক্ষমতার দাপট ও পুলিশি হয়রানির ভয় দেখিয়ে সংখ্যালঘু এবং প্রতিবেশীদের জমি দখল করে এলাকায় গড়ে তোলেন শতকোটি টাকার প্রাসাদোপম ভবন, বিশাল কমিউনিটি সেন্টার ও ফিলিং স্টেশন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সহিংসতা চালানোর অন্যতম ইন্ধনদাতা ছিলেন তিনি। তবে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর দ্রুতই পালটে যায় সে দৃশ্যপট। ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী তার ওই প্রাসাদোপম প্রমোদ ভবনসহ কমিউনিটি সেন্টার ও ফিলিং স্টেশনে হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাটের মহোৎসবে মেতে ওঠে। আর তখন থেকেই গা-ঢাকা দিয়েছেন এম সানাউল হক। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সহিংসতার ইন্ধনদাতা হিসাবে করিমগঞ্জ থানায় মামলাও হয়েছে তার বিরুদ্ধে। এমন পরিস্থিতিতে এক সময়ের প্রচণ্ড প্রতাপশালী সানাউল হকের বিলাসবহুল ভবনটি এখন ভূতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ অর্থে নির্মিত বাড়িটির সামনে দিয়ে আসা-যাওয়ার সময় মানুষ ঘৃণা প্রকাশ করছে। তার বিশাল কমিউনিটি সেন্টার ও ফিলিং স্টেশনেও ঘুঘু চরার অবস্থা।


যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ নিষ্পত্তি করে দেওয়ার কথা বলে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী বিএনপি নেতা ড. এম ওসমান ফারুকের কাছে ৫০ লাখ টাকা দাবি করেন। এর আগেও একই কথা বলে তার স্বজনদের কাছ থেকে এক কোটি টাকা নিয়েছিলেন সানাউল হক।


জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের এসপি থাকার সময় একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সঙ্গে ছয় কোটি টাকার চুক্তিতে পতিতা পল্লি উচ্ছেদ করে ১৯৯৮-৯৯ সালে প্রথম আলোচনায় আসেন সানাউল হক। তিনি আইজিপি পদমর্যাদায় মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক হন ২০২১ সালের জানুয়ারিতে। এর আগে ২০১১ সালের ১২ জানুয়ারি তিনি তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসাবে যোগ দেন। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় তার এসব পদ হয়ে ওঠে ‘টাকা বানানোর মেশিন’। অর্থ-সম্পদে রাতারাতি ফুলেফেঁপে ওঠেন তিনি। সুরজিৎ সরকার মানিকসহ তার বাড়ির আশপাশের সংখ্যালঘু ও নিরীহ মুসলিমদের পুলিশি হয়রানি-নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে নামমাত্র দাম দিয়ে ২৫ কাঠা জায়গা কব্জায় নিয়ে গড়ে তোলেন প্রাসাদোপম ওই বাগানবাড়ি। ২৪ কাঠা জায়গার ওপর গড়ে তুলেছেন একটি ফিলিং স্টেশন ও একটি কমিউনিটি সেন্টার। 


এলাকাবাসীর দেওয়া তথ্যমতে, হাওড়ে তিনি কিনেছেন কয়েকশ একর ফসলি জমি। ঢাকায় রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট-প্লট ও বিপণিবিতান। দেশের বাইরেও পাচার করেছেন বিপুল অর্থ। এমপি হয়ে মনের বাসনা পূর্ণ করতে ২০১৪ সালের নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে প্রার্থীও হয়েছিলেন। কিন্তু আসনটি জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নুর সঙ্গে আওয়ামী লীগের দলীয় সমঝোতার কারণে এমপি হওয়ার সেই খায়েশ পূরণ হয়নি সানাউল হকের। 


অভিযোগ রয়েছে, তিনি করিমগঞ্জে যখন আসতেন, তখন গাড়িভর্তি করে বস্তা বস্তা টাকা আনতেন। করিমগঞ্জ বাজারে নিজের মালিকাধীন একটি বাণিজ্যিক ভবনের কক্ষে রাখতেন এসব টাকা। ওই টাকা সামলানোর কাজে নিয়োজিত এক ছাত্রলীগ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।


করিমগঞ্জ সদরের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন ও পাভেল রহমানের অভিযোগ, তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক হিসাবে সানাউল হক আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনে মূর্তিমান আতঙ্ক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বিএনপি, জামায়াতসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের তিনি ডেকে নিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা দাবি করতেন। না দিলে যুদ্ধাপরাধের তকমা দিয়ে সাজানো মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিতেন। তার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে একপর্যায়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন ড. এম ওসমান ফারুক। 


সানাউল হকের বিপুল অঙ্কের টাকার দাবি মেটাতে না পারায় একাত্তরের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র বিএনপি-জামায়াত ঘরানার কিশোরগঞ্জ জেলা বারের আইনজীবী মো. শামসুদ্দিন আহমেদ এবং তার সহোদর একাত্তরে এসএসসি পরীক্ষার্থী সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন মো. নাসিরউদ্দিনকে যুদ্ধাপরাধ মামলায় আসামি করা হয় বলে অভিযোগ করেছেন তার পরিবার। 


২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর অ্যাডভোকেট শামসুদ্দিন গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর ধরে কারাগারে রয়েছেন। এ মামলায় ২০১৬ সালের ৩ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অ্যাডভোকেট শামসুদ্দিন আহমেদ ও তার সহোদর সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন মো. নাসির উদ্দিন আহমেদসহ ৪ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং একজনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড প্রদান করে। অ্যাডভোকেট শামসুদ্দিন আপিল করলে মামলাটি বর্তমানে রায়ের অপেক্ষায় ঝুলে রয়েছে। করিমগঞ্জে গত ২৫ ও ২৮ আগস্ট সানাউল হককে গ্রেফতার ও তার বিচারের দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন বিএনপি নেতাকর্মী ও এলাকাবাসী।


এ বিষয়ে কথা বলতে এম সানাউল হকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার রিং করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে তার এক নিকটাত্মীয় জানান, তিনি এখনো রাজধানী ঢাকা কিংবা দেশের অন্য কোথাও আত্মগোপন করে আছেন।



  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার