ঊর্ধ্বমুখী নিত্যপণ্যের বাজার, কবে হবে কার্যকরী পদক্ষেপ


, আপডেট করা হয়েছে : 06-12-2024

ঊর্ধ্বমুখী নিত্যপণ্যের বাজার, কবে হবে কার্যকরী পদক্ষেপ

শীতে শাকসবজিসহ প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের উৎপাদন বাড়ে। সরবরাহ পরিস্থিতিও থাকে স্বাভাবিক। ফলে পণ্যের দাম কমে। এতে মূল্যস্ফীতিও কমে যায়। কিন্তু এবার হয়েছে উলটো চিত্র। শীতের সবজির ভর মৌসুমেও খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে।


দেশে শীতের সবজির সরবরাহ বেড়েছে; কিন্তু দাম কমছে না। মূলত খাদ্যপণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকায় খাদ্য মূল্যস্ফীতির হারও ধারাবাহিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। গত নভেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার এ যাবৎকালে সর্বোচ্চ পর্যায়ে অর্থাৎ ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশে উঠেছে। শহরে এ হার ১৪ দশমিক ৬৩ শতাংশে উঠেছে।


এদিকে মজুরি বাড়ার হার একেবারেই কম। এ হার বেড়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছে। মজুরির চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে বেশি। নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে দশমিক ৫১ শতাংশ। এর বিপরীতে মজুরি বেড়েছে দশমিক ০৩ শতাংশ। এছাড়া মজুরির চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার অনেক বেশি অর্থাৎ ৩ দশমিক ২৮ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ মানুষের জীবিকানির্বাহের ক্ষেত্রে ওই পরিমাণে ঘাটতিতে রয়েছে। ঘাটতি অর্থ ঋণ করে সংসার চালাচ্ছে।


বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুসারে, গত মাসে দেশের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এর আগের মাসে অর্থাৎ অক্টোবরে দেশের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ।


অর্থাৎ খাদ্যপণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহের ভর মৌসুমে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের চেয়ে খাদ্যপণ্যের দাম বেশি বাড়ছে। ফলে খাদ্যবহির্ভূত খাতের চেয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হারও বেশি বেড়েছে। এদিকে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে অর্থাৎ গত বছরের নভেম্বরের তুলনায় গত নভেম্বরে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ।


বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বৃহস্পতিবার নভেম্বরের মূল্যস্ফীতি ও মজুরি হার প্রকাশ করেছে। বিবিএস-এর সেই প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।


প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, এখনো শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি। তবে এবার শহরের চেয়ে গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে।


খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার বিষয়ে সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন, সাম্প্রতিক সময়ে তিন দফা বন্যার কারণে খাদ্যের উৎপাদন কমেছে। এ কারণে দাম কিছুটা বেড়েছে। এগুলো ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।


বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি একাধিক অনুষ্ঠানে বলেছেন, মূল্যস্ফীতির হার এখন বেশি হলেও তা ধীরে ধীরে কমে যাবে। আগামী জুনের মধ্যে এ হার ৭ শতাংশের মধ্যে নেমে আসবে। আগে মূল্যস্ফীতির তথ্য গোপন করা হতো। এখন প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। এজন্য এ হার বাড়ছে।


সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বাজার ব্যবস্থাপনা ত্রুটির কারণে বাজারে সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকলেও দাম কমছে না। সরকারও বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটির সমাধান করতে পারছে না। যে কারণে পণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বেড়েই চলেছে। পণ্যের দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতির হারও বাড়ছে।


বৈশ্বিক মন্দার পর থেকে ২০২২ সালের আগস্ট থেকে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশ অতিক্রম করেছে। এখনো তা ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। গত জুলাইয়ে ডবল ডিজিটে ওঠে। আগস্টে তা কমে ডাবল ডিজিটের সামান্য নিচে নামলেও এখন আবার দুই মাস ধরে ডাবল ডিজিটের ওপরে রয়েছে।


বৈশ্বিকভাবে ২০২২ সালের শুরু থেকে মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে থাকে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়ে। মূল্যস্ফীতির হার কমাতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশ ঋণের সুদের হার বাড়াতে থাকে। ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। মানুষের ভোগের রাশ টেনে ধরে। এসব পদক্ষেপের ফলে বৈশ্বিকভাবে যেমন মূল্যস্ফীতির হার কমেছে, তেমনই অনেক দেশেই এ হার কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার এখনো ঊর্ধ্বমুখী।


এ প্রসঙ্গে ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরি বলেন, এ সময়ে মূল্যস্ফীতি কমার কথা; কিন্তু সেটি হচ্ছে না। কারণ, দেশের বাজারব্যবস্থায় কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ নেই। সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলো খুব একটা কার্যকর হয়নি। শুধু ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর কয়েকজন পুলিশ নিয়ে বাজারে গেলেই বাজার মনিটরিং করা হয় না।


হাত দিতে হবে আসল জায়গায়। নিত্যপণের মূল্যের শৃঙ্খলা ঠিক করতে হবে। উৎপাদন পর্যায় থেকে ভোক্তার হাত পর্যন্ত মাঝে অনেক ধাপ আছে; যেমন: ব্যাপারী, ফরিয়া, আড়তদার। সরকারকে খুঁজে দেখতে হবে সমস্যা কোথায়। কারা কারসাজি করছে। সেখানেই হাত দিতে হবে। মূল জায়গায় ব্যবস্থা না নিয়ে অন্য যা-ই করা হোক না কেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে না। বাজার স্থিতিশীল করতে সঠিক ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার বিকল্প নেই।


বিবিএস-এর প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, নভেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ, যা অক্টোবরে ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে এ হার ছিল ৯ দশমিক ৯২। আগস্টে ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। জুলাইয়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ।


এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতির হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছিল। এরপর আগস্ট-সেপ্টেম্বরে তা কিছুটা কমে আসে। অক্টোবর থেকে আবার বাড়তে থাকে। সেই ধারায় নভেম্বরেও বেড়েছে। প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, নভেম্বরে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ, যা অক্টোবরে ছিল ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বেড়ে নভেম্বরে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩৯ শতাংশে, যা অক্টোবরে ছিল ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ।



  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার