বাবরের অপেক্ষায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে নেতাকর্মীদের ভিড়


, আপডেট করা হয়েছে : 16-01-2025

বাবরের অপেক্ষায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে নেতাকর্মীদের ভিড়

১৭ বছর কারাবাসের পর কারামুক্ত হচ্ছেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর। তার মুক্তির অপেক্ষায় কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে ভিড় করেছে বিএনপির নেতাকর্মীরা।


বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) কেন্দ্রীয় কারাগারের সামেন এমন দৃশ্য দেখা যায়। গত ১৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের ঘটনায় অস্ত্র আইনে করা পৃথক মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের দায় থেকে খালাস পান লুৎফুজ্জামান বাবর। বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি নাসরিন আক্তারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। এ রায়ের মাধ্যমে বাবর তার বিরুদ্ধে করা সব মামলা থেকে খালাস পান। ফলে বাবরের কারামুক্তিতে আর কোনো বাধা নেই।


কারা অধিদপ্তরের সহকারী কারা মহাপরিদর্শক জান্নাত-উল-ফরহাদ কালবেলাকে বলেন, হাইকোর্টের রায় চট্টগ্রাম আদালতে যাবে। তারপর তিনি যে কারাগারে বন্দি রয়েছেন সেখানে যাবে। আদেশের কপি পাওয়ার পর কারাগার থেকে মুক্তি পাবেন তিনি।


কেন্দ্রীয় কারাগারের এক কর্মকর্তা বলেন, সব ঠিক থাকলে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাবর বৃহস্পতিবার দুপুরে মুক্তি পেতে পারেন।


নেত্রকোনা-৪ আসনে (মদন-মোহনগঞ্জ-খালিয়াজুরী) বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য লুৎফুজ্জামান বাবরের মুক্তির খবরে বিএনপি নেতাকর্মী, স্বজন ও এলাকার মানুষের মাঝে একধরনের আনন্দ-উচ্ছ্বাস তৈরি হয়েছে। তার নির্বাচনী এলাকা ছাড়াও ময়মনসিংহ, নেত্রকোনায় অসংখ্য তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। নেতার মুক্তির খবরে এলাকা থেকে দলে দলে লোকজন ঢাকায় এসেছেন। কারামুক্তির পর কারা ফটক থেকে বাবরকে বরণ করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন তারা।


লুৎফুজ্জামান বাবরের মুক্তির মধ্য দিয়ে ভাটি বাংলা তথা বাংলাদেশের গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথ প্রশস্ত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তার স্ত্রী তাহমিনা জামান শ্রাবনী। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ ১৭ বছর পর আদালতের রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের জনগণ তার মুক্তির জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে আছে। তিনিও জনগণের কাছে ফিরতে উদগ্রীব হয়ে আছেন।’


গত মঙ্গলবারের রায়ের আগে ১৮ ডিসেম্বর ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের বিশেষ ক্ষমতা আইনের চোরাচালান মামলায় মৃত্যুদণ্ড থেকে লুৎফুজ্জামান বাবরসহ পাঁচজন খালাস পান। লুৎফুজ্জামান বাবর ছাড়া খালাসপ্রাপ্ত অন্য চারজন হলেন রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিন উদ্দিন তালুকদার, তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কেএম এনামুল হক, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব নুরুল আমিন। এ ছাড়া বিচারিক আদালতের রায়ে যাবজ্জীবন দণ্ডিত ১৪ জনের মধ্যে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়াসহ পাঁচজনের সাজা কমানো হয়েছে। পরেশ বড়ুয়ার সাজা এখন ১৪ বছর করা হয়েছে। অন্য চার আসামি জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সাবেক উপপরিচালক মেজর (অব.) লিয়াকত হোসেন, তৎকালীন মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খান, তৎকালীন পরিচালক উইং কমান্ডার (অব.) সাহাব উদ্দিন আহাম্মদ ও হাফিজুর রহমানের সাজা কমিয়ে ১০ বছর করা হয়েছে।


২০০৪ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রামের সিইউএফএল ঘাট থেকে আটক করা হয় ১০ ট্রাক ভর্তি অস্ত্রের চালান। এ নিয়ে কর্ণফুলী থানায় অস্ত্র ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে চোরাচালানের অভিযোগ এনে দুটি মামলা হয়। এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে লুৎফুজ্জামান বাবরকে ৭৮ দিন রিমান্ডে রাখা হয়।


তার আইনজীবী জানান, রিমান্ডে নিয়ে লুৎফুজ্জামান বাবরের ওপর নির্যাতন চালিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায়ের চেষ্টা হয়। রিমান্ডে নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তার বড় ছেলে তারেক রহমান এ ঘটনায় জড়িত মর্মে স্বীকারোক্তি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে পুলিশ তাকে রাজসাক্ষী হওয়ার প্রস্তাব দেয়। তাতেও তিনি রাজি হননি। হাইকোর্ট শুনানিকালে এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েছেন।


২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালত এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনাল একই দিনে দুটি মামলায় রায় দেন। বিচারিক আদালতের রায়ে সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামী (অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর), সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়া এবং দুটি গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ১৪ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর আসামিদের ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। দণ্ডিত ১২ জন পৃথক আপিল করেন। মামলায় আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আপিলের ওপর ৬ নভেম্বর হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়।


পরে মারা যাওয়ার কারণে চারজনের আপিল ‘অ্যাবেট’ (পরিসমাপ্তি) ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। তারা হলেন সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামী, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আবদুর রহিম, শ্রমিক সরবরাহকারী দ্বীন মোহাম্মদ ও ট্রলার মালিক হাজি সোবহান।


২০০৭ সালের ২৮ মে আটক হন লুৎফুজ্জামান বাবর। এরপর বিভিন্ন মামলায় তার দণ্ড হয়। এর মধ্যে দুটি মামলায় তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয় এবং একটিতে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তবে গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের সরকার পতন হওয়ার পর এসব মামলার আপিল শুনানি শেষে একে একে খালাস পান বাবর। এর মধ্যে গত ২৩ অক্টোবর দুর্নীতির মামলায় ৮ বছরের দণ্ড থেকে এবং ১ ডিসেম্বর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলা থেকে খালাস পান তিনি। ২১ আগস্টের মামলায়ও বাবরকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন বিচারক আদালত।


গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিন মাসের জন্য জামিন পেয়েছিলেন লুৎফুজ্জামান বাবর। নেত্রকোনা জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও বর্তমান সদস্য মির্জা হায়দার আলী বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে গ্রেপ্তারের পর নির্বাচনের আগে মাত্র তিন মাসের জামিন পেয়েছিলেন তিনি। নানা ধরনের শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন। নির্বাচন শেষে ফের জামিন চাইতে গেলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর আর তাকে জামিন দেননি আদালত। তার মুক্তির মধ্য দিয়ে ভাটি বাংলার মানুষের স্বপ্ন পূরণের পথ খুলতে যাচ্ছে।’



  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার