নৈশভোটের দায়িত্ব পালন করা ডিসি-এসপিদের বেশির ভাগ এখনো বহালতবিয়তে


, আপডেট করা হয়েছে : 24-01-2025

নৈশভোটের দায়িত্ব পালন করা ডিসি-এসপিদের বেশির ভাগ এখনো বহালতবিয়তে

নৈশভোটের কারণে দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এবার সেই নির্বাচনের অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে রাতের ভোটের হোতা হিসাবে চিহ্নিত ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার অন্যতম বেশির ভাগ সহযোগী এখন পলাতক। আবার অনেকেই গ্রেফতার হয়ে কারাবন্দি। তবে ২০১৮ সালের ওই ভোট কারচুপি পরিচালনায় মাঠের দায়িত্বে থাকা ১১৬ জন ডিসি-এসপির বেশির ভাগ এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। চাকরিতেও আছেন বহাল। 


দুদকের পাঁচ সদস্যের একটি টিম এদের সম্পর্কে অনুসন্ধান চালাচ্ছে। সংগ্রহ করা হচ্ছে তাদের আয়কর নথি। অনেকের বিপুল অবৈধ সম্পদও পাওয়া গেছে। তবে নৈশভোট সম্পন্ন করতে মাঠ পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা থানার অফিসার ইনচার্জরা (ওসি) আছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। সে সময় থানার ওসি হিসাবে দায়িত্ব পালন করা ব্যক্তিদেরও অনুসন্ধানের আওতায় আনা দরকার বলে জনিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বিভিন্ন সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।


এ ব্যাপারে দুদক মহাপরিচালক আক্তার হোসেন বলেন, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতার অপব্যবহার, অপরাধমূলক অসদাচরণ, জাল-জালিয়াতি, দিনের ভোট রাতে করা এবং আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে সংসদ-সদস্য নির্বাচনের অভিযোগ অনুসন্ধান করা হচ্ছে। পাঁচ সদস্যের একটি টিম এ-সংক্রান্ত কাজ করছে। অনুসন্ধান শেষে বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে।


দুদক সূত্র জানায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন অনিয়মের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দিনের ভোট রাতে করা, ব্যালট জালিয়াতি, কিছু কিছু কেন্দ্রে শতকরা ৯০ ভাগের বেশি ভোট দেখানো, ব্যাপক আর্থিক লেনদেন ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রার্থীকে জেতানো। এসব অনিয়ম নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রচার ও প্রকাশিত হয়েছে। দুদকে কিছু অভিযোগ জমাও হয়েছে। মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্য ও দুদকে জমা হওয়া অভিযোগ আমলে নিয়ে এ-সংক্রান্ত অনুসন্ধান টিম গঠন করেছে কমিশন। 


দুদকে জমা হওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে, ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি মহানগর, জেলা, বিভাগীয়, উপজেলা, পৌর, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সব নেতাকর্মীকে নিয়ে নির্বাচনে জালিয়াতির দুরভিসন্ধি করা হয়েছে। এতে পুলিশের সাবেক আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারি, ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, সাবেক আইজিপি শহীদুল হক, শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা তারেক আহমেদ সিদ্দিকী, বিভাগীয় কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজিসহ জেলা প্রশাসক, জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা, পুলিশ সুপার (এসপি), ওসি, জেলা-উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশ ছিল। এসব অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য ইতোমধ্যে বিভিন্ন ভিডিও, দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ ও নির্বাচনের ফলাফলশিট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে দুদক।


সন্দেহভাজনদের বর্তমান অবস্থান নিশ্চিত করে একটি তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধেই জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বিপুল সম্পদ অর্জনের তথ্যও আছে অনুসন্ধান কর্মকর্তাদের হাতে। 


বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যমতে, শেখ হাসিনা ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা (নিজ দলীয় বিশ্বস্ত শীর্ষ নেতা ও প্রশাসনিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত) ছিলেন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাতের ভোটের ‘কুশীলব’। তাদের সাজানো ছকে মাঠ পর্যায়ে সরাসরি যুক্ত ছিলেন সে সময়ে জেলা পর্যায়ে দায়িত্বরত ৫৭ জন জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও ৬৪ জন পুলিশ সুপার (এসপি)। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও ওই ডিসি-এসপিদের বেশির ভাগ এখনো বহালতবিয়তে আছেন। চরম বিতর্কিত ওই নির্বাচনের পর তাদের ‘প্রাইজপোস্টিং’ (ভালো পদে পদায়ন) দেওয়া হয়েছে। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালালেও ওইসব ডিসি-এসপির অনেকেই এখনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। আলাপকালে দুদকের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, রাতের ভোটের সঙ্গে জড়িত ডিসি-এসপিদের সম্পর্কে আয়কর কর্মকর্তারা অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসব তথ্য জোগাড় করার কাজ চলছে। অনেকের আয়কর নথিতে উল্লিখিত সম্পদের সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই। ফলে অনুসন্ধান শেষে তাদের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ পাওয়া গেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আয়কর গোয়েন্দারাও তাদের কাছে থাকা তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখছেন। তারা কর ফাঁকির বিষয় অনুসন্ধান করছেন। কর ফাঁকি উদঘাটন হলে আয়কর আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে এনবিআর। 


দুদক জানতে পেরেছে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে একটি জরিপ করেছিল জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই)। জরিপে আওয়ামী লীগের মাত্র ২২টি আসনে জয় পাওয়ার তথ্য উঠে আসে। বাকি আসনে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য দলের জয়ের সম্ভাবনা দেখিয়েছিল সংস্থাটি। এরপর গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন ও পুলিশের যাচাই-বাছাইয়ের পর নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মনোনীত করে রাতের ভোটের ছক সাজায় পতিত স্বৈরাচারী সরকার। 


নৈশভোটের কুশীলব ও তাদের ছক অনুযায়ী কাজ করা ডিসি-এসপি, আমলা ও পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা কে কোথায় আছেন তা জানতে অনুসন্ধান চালিয়েছে যুগান্তর। জানা গেছে, এক নম্বর হোতা শেখ হাসিনা এখন ভারতে পলাতক। দুনিয়ার অন্য কোনো দেশ তাকে নিতে চায়নি বলে আলোচনা আছে। শেখ হাসিনার সাবেক প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা তারেক আহমেদ সিদ্দিকী, সাবেক আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারি ও বেনজীর আহমেদ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। তবে তাদের অবস্থান নিশ্চিত করা যায়নি। কুশীলবদের মধ্যে অন্যতম আরও কয়েকজনের মধ্যে আছেন-সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদা, সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, শেখ হাসিনার সাবেক পিএস ও সাবেক সচিব সাজ্জাদুল হাসান, সাবেক জনপ্রশাসন সচিব ড. ফয়েজ আহমেদ ও স্বরাষ্ট্র সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দিন। এদের মধ্যে আবুল কালাম আজাদ ও সাজ্জাদুল হাসান পুরস্কার হিসাবে পরে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। আবুল কালাম আজাদ বর্তমানে কারাবন্দি। সাবেক আইজিপি শহীদুল হক ও সাবেক ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া গ্রেফতার হয়ে কারাবন্দি আছেন। তবে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার বহু বিতর্কিত কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার বিশ্বাস বিদেশে পলাতক বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে বেনজীর আহমেদ ও হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে পৃথকভাবে অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শেষ করে মামলাও করেছে দুদক। শহীদুল হক ও আসাদুজ্জামান মিয়ার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলমান। 


দুদক জানতে পেরেছে, রাতের ভোটের সময় বরিশালের ডিসি ছিলেন এসএম অজিয়র রহমান। সফলতার সঙ্গে মহাকারচুপির ভোট সম্পন্ন করে দেওয়ায় তার সঙ্গে সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সখ্য গড়ে ওঠে। তার তদবিরে ‘প্রাইজপোস্টিং’ হিসাবে তিনি পদোন্নতি নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডে অতিরিক্ত মহাপরিচালকের পদে বসেন। পাউবোর অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) পদটি বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের যুগ্মসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের জন্য সংরক্ষিত হলেও অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে তিনি এই পদে বসে বেপরোয়া দুর্নীতিতে নামেন। দুর্নীতির অভিযোগে সম্প্রতি তাকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ভোট কারচুপি ও পছন্দের প্রার্থীদের জেতাতে মাঠ পর্যায়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন থানার ওসিরা। কিন্তু পদমর্যাদায় ছোট হওয়ায় তারা আলোচনা-সমালোচনার বাইরে। তাদের অনেকেই বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক। টাকা খরচ করে অনেকেই এখনো ভালো পোস্টিংয়ে আছেন। বিতর্কিত ওই ওসিদের বিরুদ্ধে আলাদা অনুসন্ধান হওয়া দরকার বলে জানিয়েছেন খোদ দুদক কর্মকর্তারা।


দুদকের কাছে তথ্য আছে-কারচুপির নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের জন্য বিপুল টাকা সরবরাহ করা হয়েছে। সেই টাকার মোটা অঙ্ক ওসিরাও পেয়েছেন। এছাড়া পছন্দের প্রার্থীদের জেতাতে এসপি ও ওসিরা কোটি কোটি টাকার চুক্তি করেন। অগ্রিম টাকা হাতে নিয়ে পছন্দের প্রার্থীদের জেতাতে কাজ করেন তারা।



  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার