অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরু


, আপডেট করা হয়েছে : 09-02-2025

অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরু

গাজীপুরসহ সারা দেশে একযোগে শনিবার সন্ধ্যা থেকে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু করেছে যৌথ বাহিনী। সম্প্রতি দেশব্যাপী চাঁদাবাজি, নাশকতা, সরকারবিরোধী লিফলেট বিতরণসহ নানা উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড ও গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর দুর্বৃত্তদের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে এই অভিযান। অভিযানের লক্ষ্য অবৈধ অস্ত্রধারী, চাঁদাবাজ, নাশকতকারী, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা। পাশাপাশি জুলাই বিপ্লবের সময় থানা ও ফাঁড়ি থেকে লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়টিকেও অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতারা সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে যৌথ বাহিনীর এই অভিযানকে ইতিবাচক বলে জানিয়েছেন। এর আগেও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে যৌথ বাহিনী অপারেশন ক্লিন হার্টসহ বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করে। যা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।


জানা গেছে, সম্প্রতি বিতর্কিত একটি পার্টির পলাতক কিছু নেতাকর্মী পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সরকারবিরোধী নানান ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারা টেলিগ্রাম, হোয়াটঅ্যাপ ও ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপ খুলে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে তাদের নেতাকর্মীদের সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলে দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র করছে। তাদের এসব উসকানিমূলক বক্তব্য শুনে দেশে থাকা ওই পার্টির নেতাকর্মীরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। সম্প্রতি মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের একটি গ্রুপে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন বেশুমার দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত বিদেশে পলাতক সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ। গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম একটি গ্রুপে বক্তব্য দিয়ে বলেন, ‘আমাদের টিম রেডি, রাজধানীতে রাতে মানুষ ঘুমাতে পারবে না। কোথা থেকে কি করতে হবে, অল্প সময়ের মধ্যে আপনারা মূল ম্যাসেজটা পাইবেন। আমরা প্রমাণ করে দিতে চাই, আমরা কার সৈনিক।’ ফেসবুক লাইভে এসে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন জাহাঙ্গীর কবীর নানক। আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী ভারতে পলাতক শেখ হাসিনার উসকানি ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচার হয়। এ ছাড়াও আরও নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্র লীগের সাবেক কয়েকজন নেতা উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের ওইসব বক্তব্য শুনে এতে বিতর্কিত পার্টির কিছু নেতাকর্মী বিভ্রান্ত হয়ে পরিকল্পিতভাবে নানামুখী নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড লিপ্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। যৌথ বাহিনীর অভিযানে ওইসব নাশকতা ও বিশৃঙ্খলাকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে।’ পাশাপাশি যারা বিভিন্ন দলীয় পরিচয় বা অন্যকোনো পরিচয় ব্যবহার করে চাঁদাবাজি ও সহিংস কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে সরকারের কমপক্ষে দুটি গোয়েন্দা সংস্থা জেলা ও এলাকা ভিত্তিক দুষ্কৃতকারী, নাশকতাকারী এবং চাঁদাবাজদের তালিকা প্রস্তুত করেছে। ওই তালিকা ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার ও যৌথ বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডারদের কাছে দেওয়া হয়েছে। যৌথ বাহিনী তালিকা ধরে তাদের গ্রেপ্তারের লক্ষ্যে অভিযান শুরু করেছে।


শনিবার তথ্য অধিদপ্তর ‘গাজীপুরসহ সারা দেশে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু শিরোনামে এক তথ্য বিবরণীতে জানিয়েছে, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে ও সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে শনিবার থেকে গাজীপুরসহ সারা দেশে যৌথ বাহিনীর সমন্বয়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শুক্রবার রাতে গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর সন্ত্রাসী আক্রমণের ঘটনায় শনিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে এক সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ বিষয়ে আজ রোববার প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে বিস্তারিত জানানো হবে।’


এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ‘গাজীপুরে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর এবং কয়েকজন আহত হওয়ার ঘটনার পর সারা দেশে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামের অভিযান শুরু করছে যৌথ বাহিনী।


শনিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা ফয়সল হাসানের পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর এই অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। শুক্রবার রাতে গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর সন্ত্রাসী আক্রমণের ঘটনায় আজ (শনিবার) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় সংশ্লিষ্ট এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে ও সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে যৌথ বাহিনীর সমন্বয়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। গাজীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িতদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করা হবে বলে স্বরাষ্ট্র মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর আশ্বাসের কয়েক ঘণ্টা পরই অভিযান শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। শনিবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতদের দেখতে গিয়ে ওই আশ্বাস দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। প্রসঙ্গত গত শুক্রবার রাত ৯টার দিকে গাজীপুর নগরের ধীরাশ্রম দক্ষিণখান এলাকায় মোজাম্মেল হকের বাড়ি ভাঙচুরের খবর পেয়ে ঠেকাতে যান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন। পরে সেখানে বাগবিতণ্ডার এক পর্যায়ে স্থানীয়রা তাদের ওপর হামলা চালায়। হামলায় আহতদের সবাইকেই প্রথমে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শনিবার মধ্যরাতে গুরুতর আহত সাতজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ওই হামলার প্রতিবাদে শনিবার দুপুরে জাতীয় নাগরিক কমিটি গাজীপুর জেলা ও মহানগর শাখার আয়োজনে বিক্ষোভ সমাবেশ শেষে নগরের ভাওয়াল রাজবাড়ি সড়ক অবরোধ করেন নেতাকর্মীরা।


ঢাকার পাশ্ববর্তী একটি জেলার পুলিশ সুপার জানান, আমরা সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, আনসারসহ সব বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে এই অভিযান পরিচালনা করব। রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত ও চাঁদাবাজদের গ্রেপ্তারই হবে এই অপারেশনের মূল লক্ষ্য।


এদিকে অপারেশন যৌথ বাহিনীর অপারেশন ডেবিল হান্ট শুরুর প্রাক্কালে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদের জননী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গিয়ে অবৈধভাবে বসবাস করছে এবং ষড়যন্ত্রমূলক অডিও রেকর্ড প্রকাশের মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করতে একের পর এক উসকানি দিচ্ছে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার উসকানিতে ইতোমধ্যে গণহত্যাকারী দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সারা দেশে গুপ্ত হামলা, ঝটিকা মিছিল ও গণসংযোগ শুরু করেছে। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে রক্তপিপাসু আওয়ামী দুর্বৃত্তরা গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর নারকীয় আক্রমণ চালিয়েছে। ১৫ জনের বেশি গুরুতর জখম হয়েছেন। পতিত সরকারের গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর ফ্যাসিস্টদের নিয়ে ভার্চুয়ালি মিটিং করে বলেছেন, ‘যে শহরে আমরা দিনের বেলা ঘুরতে পারি না, সে শহরের কাউকে আমরা ঘুমাইতে দিব না’। লীগের নয়া প্রোজেক্টের মাস্টারপ্ল্যানারদের একজন তিনি। এমন ভয়ংকর সন্ত্রাসীকে এখনো গ্রেপ্তার করতে না পারা সরকারের চরম ব্যর্থতা। দুর্নীতির মাফিয়া চক্রের অন্যতম শিখণ্ডি পলাতক সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ফ্যাসিস্ট সরকারের অনুসারীদের সঙ্গে ভার্চুয়াল কনফারেন্সে ষড়যন্ত্রমূলক সভা করছেন। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই গণহত্যার বিচার হতে হবে; কিন্তু আসামিদের গ্রেপ্তার, জেলে ও দেশের বাইরে রেখে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভবপর নয়। সচিবালয়ে গিজগিজ করছে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার প্রেতাত্মারা। পুলিশ-প্রশাসন-আদালতে তারাই সবকিছু করছে। অবিলম্বে ফ্যাসিস্টদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে আবারও হাসিনার দোসরদের পরাস্ত করা কঠিন হবে। বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় যৌথ বাহিনীর এই অভিযান অত্যন্ত ইতিবাচক।


দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে অপারেশন অপারেশন ডেভিল হান্টকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। এ বিষয়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, গত কয়েকদিন বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে তা বিবেক ও দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে অনেকটাই সমর্থনযোগ্য নয়। এসব কর্মকাণ্ডে কোনোভাবেই কোনো দায়িত্বশীল নাগরিক সম্পৃক্ত হতে পারেন না। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই। সবাই মিলে জোর দাবি তুলি, গত ১৫ বছরে যারা খুন, গুম, লুটপাট, দুর্নীতি বিশেষভাবে ২৪ এর গণহত্যা সংঘটিত করেছে, অতি দ্রুত আইনের আওতায় এনে তাদের বিচার এবং সাজা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা আশা করি, সরকারের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনগণের পক্ষে থাকবেন। নাগরিকদের জানমাল, নিরাপত্তা, ইজ্জত-আব্রু এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবেন। জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীগণকে সতর্ক থাকতে হবে যাতে কোনো অপশক্তি দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে না পারে।


গোলাম পরওয়ার দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। একই সঙ্গে পাচার ও লুণ্ঠনের অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফিরিয়ে আনা, নিরীহ জনগণের জান, মাল, ইজ্জতের নিরাপত্তা বিধান করা এবং অতি দ্রুত গণহত্যাকারীদের আইনের আওতায় এনে তাদের বিচার এবং সাজা নিশ্চিত করার জন্য আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।’



  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার