আদালতে নিজের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় তুলে ধরে রিমান্ডের আবেদন নাকচ করার দাবি করেছেন তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন শমসের মবিন চৌধুরী। তিনি আদালতকে বলেন, ‘আমি হামলায় জড়িত নই। আমি তো বিএনপির রাজনীতি করতাম।’ তখন একদল আইনজীবী বলতে থাকেন, ‘আপনি একজন পল্টিবাজ নেতা। আপনি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার অন্যতম সহযোগী।’
সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) সকালে ঢাকার সিএমএম আদালতে যাত্রাবাড়ী থানায় করা পারভেজ মিয়া হত্যা মামলায় শমসের মবিন চৌধুরী, আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান ও জুনাইদ আহমেদ পলককে ১০ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করে পুলিশ। এ আবেদনের প্রেক্ষিতে যাত্রাবাড়ী থানার পারভেজ মিয়া হত্যা মামলায় শমসের মবিন চৌধুরীসহ প্রত্যেককে ৪ দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দেন আদালত।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের হয়ে রিমান্ডের সপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন পিপি ওমর ফারুক ফারুকী। তিনি কথা বলার সময় শমসের মবিন চৌধুরী কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার বাঁ হাতে ছিল একটি ছড়ি। ডান হাত উঁচু করে বিচারকের উদ্দেশে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমি কিছু কথা বলতে চাই। আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমি তো ৫ আগস্ট বাসাতেই ছিলাম। আমি এর প্রমাণ দিতে পারবো। আমি তো বিএনপির রাজনীতি করতাম।’
শমসের মবিন চৌধুরী যখন উচ্চস্বরে কথা বলতে থাকেন, তখন একদল আইনজীবী বলতে থাকেন, ‘আপনি একজন পল্টিবাজ নেতা। আপনি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার অন্যতম সহযোগী।’
শমসের মবিন চৌধুরী আদালতকে বলেন, ‘আমি একজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। এ দেশের স্বাধীনতার জন্য আমি যুদ্ধ করেছি। আমি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। আমার এক পা হারিয়েছিলাম। আমি লাঠিতে ভর দিয়ে চলি।’ এ সময় তিনি বাঁ হাতে ধরা ছড়িটি উঁচু করে দেখান।
শমসের মবিন চৌধুরীর বক্তব্যের বিরোধিতা করেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী।
পিপি ওমর ফারুক আদালতকে বলেন, ‘শমসের মবিন চৌধুরী পল্টিবাজ নেতা। মুক্তিযুদ্ধে তিনি অংশ নিয়েছিলেন সত্য। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি সর্বোচ্চ সুযোগ–সুবিধা পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের পর শেখ মুজিবুর রহমান সরকার চিকিৎসার জন্য তাকে জার্মানিতে পাঠিয়েছিলেন। বাংলাদেশে পররাষ্ট্রসচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদেও চাকরি করেছেন। এরপর তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে পল্টি মেরে চলে আসেন বিএনপিতে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা তাকে বিশ্ব বেইমান বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।’
শমসের মবিন চৌধুরীকে নিয়ে পিপি ওমর ফারুক যখন কথা বলছিলেন, তখন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা শেখ হাসিনার সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, জুনাইদ আহ্মেদ ও দীপু মনি তার কথা শুনতে থাকেন। এরই মধ্যে একদল আইনজীবী আবারও তাকে ‘পল্টিবাজ’ নেতা হিসেবে গালমন্দ করতে থাকেন।
এ পর্যায়ে পিপি ওমর ফারুক আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, শমসের মবিন চৌধুরী বিএনপিতে থাকাকালে ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলটি তাকে বিদেশি কূটনৈতিকসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ করার দায়িত্ব দিয়েছিল। তখন তিনি বিএনপির সঙ্গে বেইমানি করেন। তিনি তখন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সঙ্গে আঁতাত করেছিলেন। বিএনপি বিষয়টি জানার পর তাকে দল থেকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর তিনি আবার আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনার কাছে গেলেন। সর্বশেষ ৭ জানুয়ারির ভুয়া নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার কাছ থেকে যে কয়েকজন টাকা নিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন, তাদের অন্যতম হচ্ছেন শমসের মবিন চৌধুরী। শেখ হাসিনার ডামি নির্বাচনেও অংশ নিয়েছিলেন তিনি।’
পিপি আরও বলেন, ৭ জানুয়ারি শেখ হাসিনার ডামি নির্বাচনে অংশ নিলেও শমসের মবিন চৌধুরী ভোটকেন্দ্রে যেতে পারেননি। এ সময় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা শমসের মবিন চৌধুরী ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, নির্বাচনে অংশ নেওয়া কোনো অপরাধ নয়। আমি ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন কেন্দ্রে গিয়েছিলাম। ভোটও দিয়েছিলাম। উনার (পিপি) কথা সঠিক নয়।’
তখন শমসের মবিন চৌধুরী হাতজোড় করে বিচারকের উদ্দেশে বলতে থাকেন, ‘মাননীয় আদালত, আমি জানতাম না, আজ আমার মামলার শুনানির দিন রয়েছে। আমার আইনজীবীও সেটি জানেন না। যে কারণে আমার আইনজীবী আদালতে উপস্থিত নেই। আমি তো ৫ আগস্ট বাসাতেই ছিলাম। বাসায় আমি সেদিন টেলিভিশনে খবরাখবর দেখছিলাম। আমার চার দিনের যে রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে, সেটি বাতিল করার জোর আবেদন করছি।’
রিমান্ডের শুনানি শেষে শমসের মবিন চৌধুরীকে পুলিশ আদালতের দোতলা থেকে হাজতখানায় নেওয়ার সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমার হাতে এখন হাতকড়া।’
শমসের মবিন বেশ কয়েকবার ডান হাত উঁচু করে ধরে সাংবাদিকদের সেই হাতকড়া দেখাতে থাকেন। এ পর্যায়ে পুলিশ তাঁর ডান হাত ধরে রাখে।
গত বছরের ১৭ অক্টোবর তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন শমসের মবিন চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর পর থেকে তিনি কারাগারে আছেন।
শমসের মবিন চৌধুরী বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১৫ সালে তিনি বিএনপির সব পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর ২০১৮ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারা বাংলাদেশে যোগ দেন তিনি। সবশেষ ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন হন তিনি। তৃণমূল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত নাজমুল হুদা। গত জাতীয় নির্বাচনের আগে তৃণমূল বিএনপিকে নিবন্ধন দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন।