‘ভুল চিকিৎসায়’ শিশুকে হত্যার অভিযোগ


, আপডেট করা হয়েছে : 28-09-2022

‘ভুল চিকিৎসায়’ শিশুকে হত্যার অভিযোগ

৮ বছরের মরিয়ম জামান আরফিয়া। ভুল চিকিৎসায় তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে তার পরিবার। একটি লাইভ ভিডিওতে আরফিয়ার মা বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের দুই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে তার একমাত্র সন্তানকে হত্যার অভিযোগ তুলে বিচার দাবি করেছেন এবং তা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। 

চিকিৎসকের এমন ভুলে সোশ্যাল মিডিয়াতে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ। এ অমানবিক ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে ও চিকিৎসকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কামনা করে আদাবর থানায় জিডি করেছেন রোগীর মা জোবাইদা আলম।

যে দুই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ উঠেছে, তারা হলেন- ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলোজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মনিরুল ইসলাম এবং ডা. ইসরাত জাহান লাকি।

আদাবর থানার জিডি ও লিখিত অভিযোগে আরফিয়ার মা জোবাইদা আলম বলেন, ‘৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে সামান্য জ্বর নিয়ে আমার একমাত্র সন্তান মরিয়ম জামান আরফিয়াকে ডা. মনিরুল ইসলামের নির্দেশে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয়। ভর্তির পর আরফিয়াকে ক্যানোলা করায় পিআইসিইউতে। তারা আমার মেয়ের রোগটা শনাক্ত না করে, ভুল ট্রিটমেন্ট শুরু করে।’

‘ডা. মনিরুল ইসলামের কাছে আমার মেয়েকে গত এক বছর ধরে রেগুলার (নিয়মিত) চেকআপ করাচ্ছিলাম। কিন্তু আমি যেই ডা. মনিরুল ইসলামের কথায় তার কাছে ভর্তি করলাম, সেই ডা. মনিরুল ইসলাম শুধু মেয়েকে নামের দেখা দেখে যেত, আমার সঙ্গে গল্পই করে যেত বেশি। অথচ আমি ডা. মনিরুল ইসলামকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করতাম। আমি ডা. মনিরুল ইসলামকে বলেছিলাম, আমি আপনার কাছে আমার সন্তানকে নিয়ে আসছি। আমি আল্লাহর পর দুনিয়াতে আপনাকে বিশ্বাস করি।’

অভিযোগে জোবাইদা বলেন, ‘ভর্তির পর থেকে সব মেডিসিন ডিসিশন দেন আরেক চিকিৎসক ডা. ইসরাত জাহান লাকি। এই ডা. ইসরাত জাহান লাকি আমার মেয়েকে ট্রিটমেন্টের জন্য দেখবেন- তা আমাদের জানানো হয়নি এবং অনুমতির প্রয়োজন মনেই করেনি তারা। এই ইসরাত জাহান লাকি একের পর এক ভুল হাইপাওয়ারের অ্যান্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন পুশ করেই চলেন সঠিক রোগ নির্ণয় না করে। এই ছোট্ট শিশু বাচ্চাটাকে নরমাল একটা জ্বরকে হাইপাওয়ারের অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে একের পর এক হাই পাওয়ারের ভুল মেডিসিন, ভুল ইঞ্জেকশন দিতেই থাকেন। একে একে ভুল স্যালাইন, ইঞ্জেকশন দিয়ে আমার মেয়েটার শরীর খারাপ করতে থাকে। একবার বলে তার টাইফয়েড আরেকবার বলে ম্যালেরিয়া। এমনকি আমাদের টেস্টের জন্য এমন বিলও করেছে, যেই টেস্ট করানোই হয়নি।’

‘উনাদের (চিকিৎসক) উদ্দেশ্য ছিল বেশি বিল বানানো। এরা জোর করে ৯ সেপ্টেম্বর বাচ্চার বুকে ইনফেকশন আছে বলে পিআইসিইউতে নিয়ে যায়। আমাদের কোনো প্রকার অনুমতি ছাড়া। অথচ পরবর্তীতে বুকের এক্সরে রিপোর্ট দেখি নরমাল। এরপর মেয়েকে দেখার জন্য বার বার অনুরোধ করলেও দেখতে দিচ্ছিল না। জোর করে দেখতে চাইলে আমাদেরকে হাজারটা নিয়ম কানুন দেখাচ্ছিল। আমার মেয়ে পিআইসিইউতে রাত ১১টা থেকে ভোর ৪টা অবধি চিৎকার করে কাঁদে। যতবার কান্নাকাটির শব্দ শুনে দেখতে চেয়েছি, ততবার দায়িত্বরতরা বলেছে আমার মেয়ে ঘুমায়। জোর করে ভেতরে ঢুকে দেখি হ্যাঁ আমার মেয়ে কাঁদছে পানির জন্য, তাকে তারা বিভিন্নভাবে অত্যাচার করছে সেজন্য কাঁদছে। একে একে অত্যাচার করে আমার মেয়েকে শেষ অবধি ডাক্তার নামের কসাইরা মেরেই ফেলে। মেরেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, তারা লাইফ সাপোর্ট দিয়ে এক সপ্তাহ রাখার প্ল্যান করে। ওরা যখন আমার মেয়েকে জোর করে পিআইসিইউতে নিয়ে চলে আসে, আমি মা হয়ে তাদের (চিকিৎসক) পা ধরে বলেছিলাম, আপনাদের হাজারটা রোগী থাকতে পারে, আমার ও আমার স্বামীর এই একটাই সন্তান। আমাদের এই দুনিয়াটা আমার এই সন্তানকে ঘিরেই। দয়া করে আমার সন্তানটাকে সুস্থভাবে না হোক, জীবিত ফেরত দিয়েন। কিন্তু তারা আমার কোনো কান্নাই শুনেনি।’

অভিযোগে জোবাইদা বলেন, ‘তারা (চিকিৎসক) আমাদেরকে ব্যস্ত রাখার জন্য একবার ডায়াপার লাগবে বলে, আরেকবার ব্ল্যাড ডোনার লাগবে বলে নাটক করে। ডায়াপার ওদের ফার্মেসি থেকে নিতে বললে তারা আমাদের জানায় ওদের কাছে নেই। ব্ল্যাড না দিয়েও ব্ল্যাডের জন্য ৪০ হাজার টাকা বিল করে। কত কত অত্যাচার করে শেষ অবধি তারা আমার একমাত্র মেয়েটাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিল।১০ সেপ্টেম্বর ভোরে ডাক্তারের অবহেলা, সঠিক সময়ে সঠিক ট্রিটমেন্ট না দিয়ে, ভুল হাইপাওয়ারের অ্যান্টিবায়োটিক মেডিসিন দিয়ে আমার মেয়েটাকে মেরেই ফেলল। আমি ও আমার স্বামী এখন বেঁচে থেকেও জিন্দা লাশ হয়ে বেঁচে আছি।’

জোবাইদা তার অভিযোগে আরও বলেন, ‘এ রকম ডাক্তারের বিচার করার ক্ষমতা কি বাংলাদেশে কোনো সংস্থার নাই। এদের লাগামহীন অত্যাচারের অন্যায়ের কোনো শাস্তি হয় না। এরা এক একটা তাজা প্রাণ শেষ করে দেয়, সুন্দর সংসার শেষ করে দেয় শুধুমাত্র টাকার লোভে। এর আগেও কয়েকবার শুনেছি এখানে ভুল চিকিৎসার অনেক ঘটনা ঘটেছে।’

‘ভুল চিকিৎসার সব প্রমাণ’ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরে ফিরছেন জোবাইদা আলম। ডা. মনিরুল ইসলাম ও ডা. ইসরাত জাহান লাকির বিচার চেয়ে মামলাও করবেন তারা। ভুল চিকিৎসার প্রতিকার চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছেও অভিযোগ দিয়েছেন। সঙ্গে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের ভুল চিকিৎসার প্রমাণপত্রও দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

আরফিয়ার বাবা আরিফ উজ জামান কান্না জড়িত কণ্ঠে যুগান্তরকে বলেন, ‘ডা. মনিরুল ইসলাম ও ডা. ইসরাত জাহান লাকি কোনো রোগ শনাক্ত না করে চিকিৎসা করতে গেলেন। উনি (ডা. ইসরাত) কেন হাইপাওয়ার অ্যান্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন পুশ করতে গেলেন? উনি ওভার কনফিডেন্ট হয়ে আমার মেয়েকে বার বার ভুল ওষুধ প্রয়োগ কেন করেছেন। আমার সব আশা ভরসা শেষ। শুরুতেই তিনি ভুল করেছেন। উনার গাফিলতির জন্যই আমার কলিজার টুকরাকে হারিয়েছি। আমার স্ত্রী দিনরাত কবরের পাশে পড়ে থাকেন। এ ঘটনার পর থেকে হাসপাতালে যাচ্ছেন না দুই ডাক্তার। ফোনেও পাওয়া যায়নি তাদের। যেহেতু অভিযোগ হাসপাতালের ডাক্তার এবং ম্যানেজমেন্টের বিরুদ্ধেই, তাই সব প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন হাসপাতাল ম্যানেজার।’

এদিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দিয়েও কোনো সদুত্তর পায়নি বলে জানিয়েছে ভুক্তভোগী পরিবারটি। মেডিকেল কাউন্সিলেও ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন তারা। 

হাসপাতাল থেকে কেউ এই দুর্ঘটনার পর কথা বলতে আসেনি জানিয়ে শিশুটির জোবাইদা আলম যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তাদের থেকে কোনো উত্তর পাইনি। আমাদের সঙ্গে যা হয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমার মেয়েটাকে তারা হত্যা করেছে। আমাদের আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার একটাই কারণ, অন্যায় হলে তার প্রতিবাদ অবশ্যই করতে হবে বলে আমরা মনে করি। এই অমানবিক ঘটনার জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রত্যাশা করি এবং এরকম ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। তার সঙ্গে সঙ্গে দোষী চিকিৎসকের দৃষ্টান্তমূলক সাজা যেন হয়, এটাই আমাদের চাওয়া। 

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. মনিরুল ইসলাম এবং ডা. ইসরাত জাহান লাকি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত জবাব দেব। যা সেই হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমে জানিয়ে দেবে।’


  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার