নামে-বেনামে তিন ব্যাংক থেকে ৬৩৭০ কোটি টাকা হাতিয়েছে নাবিল গ্রুপ


, আপডেট করা হয়েছে : 03-10-2022

নামে-বেনামে তিন ব্যাংক থেকে ৬৩৭০ কোটি টাকা হাতিয়েছে নাবিল গ্রুপ

পর্যাপ্ত জামানত ছাড়াই ইসলামি শরিয়াহ-ভিত্তিতে পরিচালিত তিনটি ব্যাংক থেকে ছয় হাজার ৩৭০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে নাবিল গ্রুপ। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে বিশাল অঙ্কের এ ঋণ অনুমোদন হয়েছে। আইনের তোয়াক্কা না করেই গ্রুপটির নামে-বেনামে বিভিন্ন কোম্পানিকে ঋণ অনুমোদন করেছে ব্যাংক তিনটি। যদিও এত বিশাল অঙ্কের টাকা ব্যয় করার সক্ষমতা নেই এসব প্রতিষ্ঠানের। এমনকি ঋণের নথিও গায়েব করে দেয়া হয়েছে।


সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, লোপাটের উদ্দেশ্যেই ছলছাতুরির মাধ্যমে ঋণ বাগিয়েছে প্রভাবশালী একটি চক্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক পরিদর্শনে এমন চিত্র উঠে এসেছে। বিষয়টি অধিকতর তদন্তের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন বিভাগে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়েছে।


কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে আসা তথ্যানুযায়ী, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড চার হাজার ৫০ কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এক হাজার ২০০ কোটি টাকা এবং সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক এক হাজার ১২০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে অখ্যাত গ্রুপটিকে। এসব ঋণ অনুমোদনের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো ধরনের জামানত রাখা হয়নি। এ ছাড়া ঋণের অর্থ কোথায় ব্যবহার হবে তাও পরিষ্কার নয়।


তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গ্রুপের একটি কোম্পানিকে ৯৫০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সর্বশেষ সিআইবি (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) রিপোর্ট অনুসারে, এর আগে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ওই কোম্পানির ঋণ রয়েছে মাত্র সাড়ে আট লাখ টাকা। অর্থাৎ ঋণের অর্থ ব্যবহারের সক্ষমতা আছে কি-না তা যাচাই না করেই অনুমোদন দেয়া হয়েছে।


অন্যদিকে, একই গ্রুপের একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে ব্যাংক কোম্পানি আইনে থাকা ঋণসীমা (সিঙ্গেল পার্টি এক্সপোজার লিমিট) লঙ্ঘন করা হয়েছে। এসব ঋণ ব্যাংকের পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে বেনামি ঋণ হিসেবে সন্দেহ করে প্রতিবেদন দাখিল করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল। অধিকতর পরীক্ষার জন্য ব্যাংকগুলোর কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে।


এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে নাবিল গ্রুপ, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে সাংবাদিকরা। মোবাইল ফোনে বারবার কল দিয়ে ও হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও নাবিল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিনুল ইসলামের মন্তব্য পাওয়া যায়নি।


সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাফর আলমের ব্যক্তিগত মোবাইলফোনে কল দিয়ে মন্তব্য জানার চেষ্টা করা হয়। কল রিসিভ করে ব্যস্ততার কথা জানান এমডির সহকারী। পরবর্তিতে ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে প্রশ্ন পাঠালেও তিনি উত্তর দেননি। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুল মওলাকে একাধিকবার ফোন ও ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ফোন রিসিভ করেননি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ ওয়াসেক।


বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য মতে, তিন ব্যাংকের মোট অনুমোদিত ঋণ বা বিনিয়োগ ছয় হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখায় নাবিল ফিড মিলস ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে তিন হাজার ১০০ কোটি টাকা ঋণ বা বিনিয়োগ চলতি বছরের ২১ মার্চ ব্যাংকের ৩০৮তম বোর্ডসভায় অনুমোদন দেয়া হয়। ব্যাংকটির গুলশান শাখায় নাবিল গ্রেইন ক্রোপসের নামে অনুমোদন দেয়া হয় ৯৫০ কোটি টাকা ঋণ।


এ ছাড়াও চলতি বছরের ২৩ জুন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ২৪৬তম বোর্ডসভায় নাবিল নব ফুড ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান, নাবিল ফিড মিলস ও শিমুল এন্টারপ্রাইজের নামে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়। একই বছরের ৩০ মে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৪৮১তম বোর্ডসভায় গুলশান শাখা থেকে নাবিল নব ফুড ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান নাবিল ফিড মিলস ও শিমুল এন্টারপ্রাইজের নামে এক হাজার ১২০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে তিন ব্যাংকের কাছে অখ্যাত এই গ্রুপটির ঋণের পরিমাণ ছয় হাজার ৩৭০ কোটি টাকা।


প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের গুলশান শাখার গ্রাহক নাবিল ফুডসের সহযোগী প্রতিষ্ঠান নাবিল ফিড ও শিমুল এন্টারপ্রাইজের নামে এক হাজার ১২০ কোটি ঋণ দেয়া হয়। এর মধ্যে ফান্ডেড (নগদ) ৪৫০ কোটি এবং নন ফান্ডেড (এলসি ও ব্যাংক গ্যারান্টি) ৬৭০ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ সীমা নতুনভাবে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোন খাতে এই টাকা ব্যবহার হবে তা উল্লেখ নেই। তাই নতুন একজন গ্রাহককে বিপুল ঋণ অনুমোদনের বিষয়টি যাচাই করতে সুপারিশ করা হয়েছে।


ব্যাংকগুলোর কাছে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয় জানতে চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ফোর্সড (বাধ্যতামূলক) ঋণ আদায় অগ্রগতি অবহিত করা, কোন বিবেচনায় এই ঋণ দেয়া হলো তার ব্যাখা দিতে হবে। এ ছাড়া ঋণ অনুমোদন সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে বলা হয়েছে।


প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, এত বড় অংকের ঋণের বিপরীতে কোনো জামানত নেয়া হয়নি। তিন মাসে এলসি কমিশন মাত্র দশমিক ১৫ শতাংশ। গ্যারান্টির ক্ষেত্রে নাবিল ফার্মের কর্পোরেট গ্যারান্টি গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংকটির ৪৮১তম বোর্ডসভায় ঋণ অনুমোদন দেয়া হলেও ৪৮২ ও ৪৮৩তম বোর্ডসভায় ঋণের শর্ত শিথিল করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অনুমোদনের সময় ব্যক্তিগত গ্যারান্টির ক্ষেত্রে সব পরিচালক ও তাদের স্বামী-স্ত্রীর গ্যারান্টি ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে শর্ত শিথিল করে শুধু পরিচালকদের গ্যারান্টি রাখা হয়।


আমানত সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বলা হয়েছিল- নিজ নামে অথবা রেফারেন্সে অন্যদের নামে প্রাথমিকভাবে ২০০ কোটি ও পরবর্তীতে আমানত ৬০০ টাকায় উন্নীত করতে হবে। কিন্তু পরে তা শিথিল করে বলা হয়, পর্যাপ্ত আমানত রাখতে হবে।


এই পর্যাপ্ত আমানতের ব্যাখ্যাও দেয়া হয়নি। একটি নতুন ঋণের ক্ষেত্রে কোন বিবেচনায় শর্ত শিথিল করা হলো তা জানা জরুরি বলে মত দিয়েছে পরিদর্শক দল। এছাড়াও গ্রাহক বেনামে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানটি কি-না, সেটিও যাচাই করতে বলা হয়েছে।


বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইসলামী ব্যাংকের গুলশান শাখার নতুন গ্রাহক নাবিল গ্রেইন ক্রপসের অনুকূলে ৯৫০ কোটি টাকা নন ফান্ডেড ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংকের নীতিমালা অনুসারে ২৩০ কোটি টাকা জামানত হওয়ার কথা। ঋণের শর্তে ১১০ কোটি টাকার আমানত অথবা লিয়েন থাকার কথা বলা হয়েছে।


এক জায়গায় বলা আছে, কৃষিপণ্য আমদানি ও বিপণনের জন্য এই অর্থ ব্যবহার করা হবে। কিন্তু সর্বশেষ সিআইবি প্রতিবেদন অনুসারে বিভিন্ন ব্যাংকে ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকের মোট এক্সপোজার মাত্র সাড়ে আট লাখ টাকা।


প্রকল্প ঋণ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গ্রাহক একেবারে নতুন। ফলে সম্পূর্ণ নতুন একজন গ্রাহককে বাণিজ্যের জন্য এই পরিমাণ ঋণ দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের বড় ব্যবসা পরিচালনার দক্ষতা ও অর্থের সঠিক ব্যবহার হয়েছে কি-না তা যাচাই করা দরকার।


এছাড়াও নাবিল ফিড মিলসের নামে নতুন করে ৭০০ কোটি টাকাসহ মোট তিন হাজার ১০০ কোটি টাকা অনুমোদন দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক রাজশাহী শাখা। কিন্তু নাবিল গ্রেইন ক্রপস কোনো গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শকদের সন্দেহ- এটিও গ্রুপের প্রতিষ্ঠান। ফলে একক কোনো গ্রুপকে ঋণ দেয়া সংক্রান্ত যে আইন রয়েছে, এ ক্ষেত্রে তা লংঘন করা হয়েছে।


সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো ব্যাংক একক কোনো প্রতিষ্ঠানকে ফান্ডেড ও নন ফান্ডেড মিলিয়ে তার পরিশোধিত মূলধনের ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দিতে পারে। এর মধ্যে ফান্ডেড ১৫ শতাংশ ও নন ফান্ডেড ২০ শতাংশ। আর বর্তমানে এই তিন ব্যাংকের মোট পরিশোধিত মূলধন তিন হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে গ্রুপটিকে এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ঋণ দেয়া হয়েছে প্রায় পাঁচগুণ বেশি।


নাবিল গ্রুপের ওয়েবসাইটের তথ্য মতে, গ্রুপটির ১৭টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলো হলো- নাবিল নব ফুড, ফ্লাওয়ার মিল, ফিডমিল, অটো-রাইসমিল, ডাল মিল, কনজুমার প্রডাক্ট, নাবিল ফার্ম, ক্যাটল ফার্ম ও নাবিল ট্রান্সপোর্ট উল্লেখযোগ্য।


কিন্তু এই ওয়েব সাইটে প্রোডাক্ট অপশনে মাত্র ছয়টি পণ্যের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- চাল, আটা, ময়দা, সুজি, ডাল ও পশুখাদ্য। কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন মো. জাহান বক্স মণ্ডল, পরিচালক ইসরাত জাহান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম ও উপপরিচালক মো. মামুনুর রশীদ।


  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার