রুয়েটে বই কেনায় জালিয়াতি, দেড়শ’ টাকার ফটোকপি বই ৫১৮০টাকা!


, আপডেট করা হয়েছে : 05-11-2022

রুয়েটে বই কেনায় জালিয়াতি, দেড়শ’ টাকার ফটোকপি বই ৫১৮০টাকা!

ভারতের এস চাঁদ প্রকাশনীর ড. আর ডি মদনের লেখা ‘মডার্ন ইনোগ্রানিক কেমিস্ট্রি’ মূল বইয়ের মুদ্রিত দাম ১ এক হাজার ২৮০রুপি। কিন্তু বইটির ফটোকপিই কেনা হয়েছে ৫ হাজার ১৮০টাকায়। এ বইয়ের দুটি কপি কেনা হয়েছে ১০হাজার ৩৬০টায়। অথচ রাজশাহী নগরীর সোনাদীঘি মোড়ের সবুজ লাইব্রেরির মালিক আবু মুসা বলছেন, বইটির ফটোকপি তারা বিক্রি করেন ১৫০টাকায়। আর মুল কপির দাম পড়বে দুই হাজার টাকার কিছু বেশি।

রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-রুয়েটে ১০লাখ টাকার বই কেনাকাটায় এরকম জালিয়াতি হয়েছে। মুল বই কেনার কথা ছিল। কিন্তু ছাপাখানা ও কম্পিউটার কম্পোজের দোকান থেকে গোপনে কেনা হয়েছে ফটোকপি। সেই ফটোকপি বইয়েরই আবার দাম পরিশোধ করা হয়েছে মূল বইয়ের প্রকৃতমূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। বই কেনার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় অধ্যাপক ও কর্মকর্তা মিলেমিশে পকেট ফুলিয়েছেন। বিল পরিশোধের পর ক্রয় কমিটিকে ‘ক্লিনচিট’ দিয়ে মুখে তালা এঁটে ঘুরে বেড়াচ্ছে খোদ যাচাই কমিটিও।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০২১ সালের ১৬জুন রুয়েটের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির ভারপ্রাপ্ত লাইব্রেরিয়ান মাহবুবুল আলম জরুরিভিত্তিতে প্রায় তিন লাখ টাকার বই কেনার জন্য উপাচার্যের কাছে আবেদন করেন। আবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, স্ট্যান্ডার্ড রিকোয়েস্ট ফর কোটেশন-এসআরএফকিউ’র মাধ্যমে জরুরিভিত্তিতে মূল বই কেনা হবে। একইদিনই আবেদনটি গ্রহণ করে বই কেনার অনুমোদন দেন তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক রফিকুল আলম শেখ। পরে রংপুরের কমটেক কম্পিউটার এন্ড প্রিন্টার্স-২ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ইটিই, আইপিই, জিসিই, ইউআরপি এবং এমটিই বিভাগের বই সরবরাহের অর্ডার দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি বইও সরবরাহ করেছে। কিন্তু মূল বই নয়। নেয়া হয়েছে ফটোকপি বই।

জানা গেছে, কমটেক কম্পিউটার এন্ড প্রিন্টার্স-২ নামে প্রতিষ্ঠানটি কোনো লাইব্রেরি নয়। ছাপাখানার ব্যবসা তাদের। রংপুর সিটি কর্পোরেশন থেকে নেয়া ট্রেড লাইসেন্সেও দেখা যায়, ব্যবসার বিবরণে ‘ছাপাখানা’ লেখা রয়েছে। রুয়েটের ভারপ্রাপ্ত লাইব্রেরিয়ান মাহবুবুল আলম কতিপয় অধ্যাপক ও প্রকৌশল শাখার কর্মকর্তার যোগসাজশে মূল বই বাদ দিয়ে ফটোকপি কিনেছেন। সেই ফটোকপিগুলোর জন্য মূল বইয়ের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি দাম পরিশোধ দেখানো হয়েছে।

একইভাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে রাজস্বখাত থেকে প্রায় দুই লাখ টাকার বই কেনার অনুমোদন দেন উপাচার্য। পরে ২৭ জুন রংপুরের হাইটেক ডিজিটাল সাইন নামে আরেকটি ছাপাখানাকে বই সরবরাহের অর্ডার দেয়া হয়। তারা এমএসই, ম্যাথেম্যাটিকস, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি ও ইকোমিক্স বিভাগের বই সরববরাহ করেছে।

কিন্তু ২০২১-২০২২ অর্থবছরে রংপুর সিটি কর্পোরেশন থেকে নেয়া হাইটেক ডিজিটাল সাইনের ট্রেড লাইসেন্সে ব্যবসার বিবরণে লেখা আছে ‘ছাপাখানা স্বয়ংক্রিয় মেশিন’। এখান থেকেও ফটোকপি বই কেনা হয়েছে। মূল বই নয়। ফটোকপি বইয়ের দাম পরিশোধ করা হয়েছে মূল বইয়ের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি। এভাবে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চার লটে ১০ লাখ টাকার বই নেয়া হয়েছে।

বই সরবরাহের পর ২০২২ সালের ২৬ মে রুয়েটের প্রধান প্রকৌশলীর কাছে দুই লাখ ৮৮হাজার ৭৮০টাকার বিল (ইনভয়েস নং ২০২২২৯০১১৫৫) দাখিল করে কমটেক কম্পিউটার অ্যান্ড প্রিন্টার্স। তারা ইটিই, আইপিই, জিসিই, ইউআরপি এবং এমটিই বিভাগের বই সরবরাহ করেছে। একই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান একই তারিখে দুই লাখ ২৯ হাজার ৮৮০টাকার বিল (ইনভয়েস নং ২০২২২৯০০১৫৩) জমা দেয়। এই বিলে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি আর্কিটেকচার, বিইসিএম, সিএফপিই এবং ইসিই বিভাগের বই সরবরাহ করেছে।

এদিকে, সিই, ইইই, এমই এবং সিএসই বিভাগের বই সরবরাহ দিয়েছে হাইটেক ডিজিটাল সাইন। তারাও ২৬ মে তারিখেই দুই লাখ ৯৯হাজার ৪২৭টাকার বিল দাখিল করে টাকা তুলে নিয়েছে। এছাড়াও, এমএসই, ম্যাথেম্যাটিক্স ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রি বিভাগের বই সরবরাহের জন্য একই তারিখে এই প্রতিষ্ঠানটি এক লাখ ৭৯ হাজার ২৯০টাকার বিল পেয়েছে। এভাবে মোট দুই প্রতিষ্ঠানকে ৯ লাখ ৯৭ হাজার ৩৭৭ টাকা বিল পরিশোধ করা হয়েছে।

রুয়েটের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি উন্নয়ন কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ফারুক হোসেন বলেন, ‘বইগুলো কেনার সময়ই নানা অভিযোগ ছড়িয়ে পড়ে ক্যাম্পাসে। আমি শক্ত প্রতিবাদ করে বলেছিলাম ফটোকপি বই লাইব্রেরির জন্য কেনা যাবে না। মূল বই-ই কিনতে হবে। কিন্তু ওপেন টেন্ডার না করে এসআরএফকিউ’ মাধ্যমে চারটি লটে বই কেনার প্রক্রিয়া করে। তারা আমাকে না জানিয়েই গোপনে ফটোকপি বই কিনে লাইব্রেরিতে ভরেছে। বইগুলো হাতে নিলেই বোঝা যায় ফটোকপি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় এধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি কোনোভাবেই মানা যায় না’।

নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, বই কেনার পর গুণগত মান যাচাইয়ে গত ৮ ফেব্রুয়ারি কর্মকর্তা নিয়োগে কেন্দ্রীয় ভাণ্ডার থেকে উপাচার্যের নিকট নোটশীট দেয়া হয়। পরদিনই অধ্যাপক আবু সুফিয়ান মো. জিয়া হাসানকে প্রধান করে তিন সদস্যের যাচাই কমিটি গঠন করেন উপাচার্য। এই কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- অধ্যাপক আলী হোসেন ও প্রকৌশলী নোমান পারভেজ।

বই কেনাকাটায় গুরুতর অনিয়ম ও ফটোকপি বই কেনার অভিযোগের বিষয়ে জানতে যাচাই কমিটির প্রধান অধ্যাপক আবু সুফিয়ান মো. জিয়া হাসানের সাথে দেখা করা হলেও কোনো কথাই বলতে রাজি হন নি। এই কমিটির আরেক সদস্য অধ্যাপক আলী হোসেনও এ বিষয়ে মুখ খোলেন নি। বই কেনাকাটা ও গুণগত মান যাচাইয়ে কোনো অনিয়ম পেয়েছেন কি না-এমন প্রশ্নেরও তিনি কোনো উত্তর দেন নি।

বুধবার দুপুরে রুয়েটের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখা যায়, পুরাতন ভবনে একটি কক্ষের র‌্যাকে রাখা হয়েছে বেশ কিছু বই। কক্ষটি সংস্কারের কাজ চলছে। সেখানে বেশ কয়েকটি বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে ফটোকপির প্রমাণ পাওয়া গেছে। বইয়ের গ্রাফ ও ছবিগুলো অস্পষ্ট। লেখাও অস্পষ্ট। এসময় এ প্রতিবেদকের সাথে ভারপ্রাপ্ত লাইব্রেরিয়ান মাহবুবুল আলমও উপস্থিত ছিলেন। এসময় তিনি বলেন, ‘মূল বইয়ের নামে বেশ কিছু ফটোকপি বই আমাদের সরবরাহ করেছিল ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান দুটি। পরে সেগুলো থেকে বেছে বেছে কিছু দেয়া পরিবর্তনও করা হয়েছিল। তবে এখনো হয়তো কিছু ফটোকপি বই থেকে যেতে পারে’।

বইয়ের কেনার বিল দেখালে আশ্চর্য হয়ে যান রাজশাহী নগরীর সোনাদীঘি মোড়ের সবুজ লাইব্রেরির মালিক আবু মুসা। তিনি জানান, এগুলোর পাইরেসি কপি হয় বিক্রি ২০০ টাকা -৩৫০টাকার মধ্যে। কিন্তু কীভাবে তারা এই কাজ করেছেন! এটা তো চরম ঘাপলা। সরকারি টাকা হরিলুট হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।

বই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কমটেক কম্পিউটার অ্যান্ড প্রিন্টার্স-২ এর মালিক একেএম খুরশীদ আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমাদের ছাপাখানার ব্যবসা। লাইব্রেরি নাই। বই সরবরাহের জন্য আলাদা কোনো লাইসেন্সও নাই। তবে আমরা অন্য পার্টির কাছ থেকে কিনে নিয়ে রুয়েটে বই সরবরাহ করেছি।

তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম শেখ বলেন, ‘বই কেনায় কোনো দুর্নীতি বা জলিয়াতি হয়েছে কি না আমার নেই’।

এ বিষয়ে টিআইবি-সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) এর রাজশাহী শাখার সভাপতি অধ্যাপক দীপকেন্দ্রনাথ দাস বলেন, শিক্ষকরাও যদি পয়সার কাছে নিজেদের বিবেক ও আত্মমর্যাদা বিক্রি করে তাহলে জাতি আর কোথায় যাবে! এটি জাতির জন্যই লজ্জার বিষয়। রুয়েটে বই কেনায় দুর্নীতির বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে দুদককে অবহিত করা হবে বলেও জানান তিনি।


  • সম্পাদক ও প্রকাশক: ইঞ্জিনিয়ার মো: রায়হানুল ইসলাম

  • উপদেষ্টাঃ মোঃ ইব্রাহীম হায়দার