রাজউক পূর্বাচল ৩০০ ফুটসংলগ্ন এলাকায় প্লট বিক্রির নামে ভয়াবহ প্রতারণায় নেমেছে পূর্বাচল নর্থসাউথ গ্রিনসিটি। কুড়িল থেকে ১৮/২০ কিলোমিটারের মধ্যে কাঠাপ্রতি মাত্র ২ থেকে ৪ লাখ টাকার মধ্যে আবাসিক এলাকায় প্লট এবং ২০ কাঠার ইন্ডাস্ট্রিয়াল (শিল্প) প্লট ২০ লাখ টাকায় বিক্রির নামে ভয়াবহ প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেই সঙ্গে প্লট বুকিং দিলেই নানা পুরস্কারের লোভনীয় প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। অথচ বালু নদীর ওপারে নর্থসাউথ গ্রিনসিটি নামের ওই প্রকল্পের পাশেই আবাসন প্রকল্পে প্রতি কাঠা জমি ৬০ থেকে ৮০ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ম্যাপ দেখিয়ে জমি বিক্রি শুরু করলেও এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির নেই রাজউকের অনুমোদন বা পরিবেশ ছাড়পত্র। গ্রাহককে ধোঁকা দিতে ছাপানো হয়েছে আকর্ষণীয় একাধিক প্রচারপত্র। তাতে বড় করে লেখা হয়েছে রাজউক ও গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিবন্ধনকৃত প্রকল্প। ব্রুশিউরের মধ্যে ঘোলা করে ছাপানো হয়েছে রাজউক কর্তৃক প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন সনদের ছবি, যা কোনোভাবেই ওই প্রকল্পের নিবন্ধনের প্রমাণ নয়। ওই সনদের মধ্যে লেখা রয়েছে, ‘এই নিবন্ধীকরণ/তালিকাভুক্তি কোনোক্রমেই প্রকল্পের অনুমোদন বোঝায় না এবং প্রকল্পের অনুমোদন ব্যতীত প্রকল্পসংক্রান্ত কোনো প্রকার বিজ্ঞাপন, পত্রপত্রিকা, সাইনবোর্ড/বিলবোর্ড বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার-প্রচারণা চালানো যাবে না। এ ধরনের বিধিবহির্ভূত কার্যক্রম গ্রহণ করলে কর্তৃপক্ষ অত্র নিবন্ধন বাতিলসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।’ অথচ এই সনদের ছবি দেখিয়েই গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণায় মেতেছে নর্থসাউথ সিটি।
এদিকে বছরজুড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্লটের থ্রিডি ছবি ও ম্যাপ দিয়ে নামমাত্র মূল্যে প্লট বিক্রির লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। মাঝেমধ্যে সংবাদমাধ্যমেও বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। গ্রাহক টানতে তাদের রয়েছে বিভিন্ন এমএলএম কোম্পানির প্রশিক্ষিত প্রতারকদের গ্রুপ। তাদের মাধ্যমে প্রায়ই আবাসন মেলার আয়োজন করে থাকে নামিদামি রেস্টুরেন্টে এবং সেখানে সাধারণ লোকজনকে বিশেষ করে প্রবাসীদের আইওয়াশ করে প্লট বিক্রি করেন। বালু নদীর ওপারে পূর্বাচল নিউ টাউনের কাছে এবং জলসিঁড়ি আর্মি হাউজিংয়ের ঠিক পাশেই লোকেশন দেখিয়ে বাজারমূল্যের চেয়েও অনেক কম মূল্যে জমি বিক্রির লোভনীয় প্রস্তাব দিয়েছে নর্থসাউথ গ্রিনসিটি নামের প্রতিষ্ঠানটি। পরিচয় গোপন রেখে তাদের অফিসে গিয়ে জমি কেনার আগ্রহ দেখালে তারা প্রতি কাঠা জমির মূল্য দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা প্রস্তাব করে। এছাড়া ভিআইপি ব্লকে দাম ধরা হয়েছে ৪ লাখ টাকা। মেগা সেল উপলক্ষ্যে ৫০ শতাংশ মূল্যহ্রাসসহ হরেক মূল্যবান পুরস্কারের কথা বলা হয়। ক্রেতা সেজে তাদের প্রকল্পে গেলেও রাজউক অনুমোদন বা পরিবেশ ছাড়পত্র দেখাতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নর্থসাউথ গ্রিনসিটির একজন কর্মকর্তা জানান, এই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেএম ইউসুফ আলী একসময় ওয়েল কেয়ার সিটির সামান্য বেতনে বিক্রয়কর্মী হিসাবে চাকরি করতেন। ওই সময়ই তিনি জমি নিয়ে প্রতারণার কলাকৌশল রপ্ত করেন। আরও কয়েকজন সমমনা কর্মীদের নিয়ে চাকরি ছেড়ে এক বছর আগে জমিসহ সাইনবোর্ড ভাড়া নিয়ে গড়ে তোলেন নর্থ সাউথ সিটি। আর এই এক বছরে প্রতারণা করে গড়ে তুলেছেন নর্থসাউথ গ্রুপ। এখন পর্যন্ত জমি কিনেছেন কয়েক বিঘার মতো আর বিক্রি করেছেন প্রজেক্ট লে-আউটের পুরো ৩২০ বিঘার ১৩৩০টি প্লট। এক প্লট কমপক্ষে ২০ থেকে ৫০ বার বিক্রি করেছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রজেক্টের লে-আউট প্ল্যান চেঞ্জ করেছেন তিনবার যেন গ্রাহকরা এই প্রতারণা বুঝতে না পারেন। প্রতিমাসে হাওয়ার উপরে ৫/৭ কোটি টাকা সেল করে নর্থসাউথ সিটি। এত ভয়াবহ জালিয়াতি কোম্পানিতে চাকরি করে প্রতিদিন গ্রেফতার আতঙ্কে ভুগছি। কারণ, যখন গ্রাহকরা বুঝতে পারবে এই ভয়াবহ প্রতারণার কৌশল, তখন তো অবশ্যই পুলিশ মালিক-কর্মচারী সবাইকেই ধরবে। আমি যে কোনো মুহূর্তে এখান থেকে চলে যাব। চাকরি ছাড়ার কথা বললে আমাকে তারা ঝামেলায় ফেলবে। কারণ, তাদের সব কুকীর্তি একমাত্র আমি ভালোভাবে জানি। অভিযোগের বিষয়ে কেএম ইউসুফ আলী মোবাইল ফোনে বলেন, হ্যাঁ, আমি একসময় ওয়েল কেয়ারে চাকরি করতাম। আমাদের প্রায় ৭০ বিঘা জমি কেনা আছে। লে-আউট প্ল্যান চেঞ্জ করা নিয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি সঠিক নয়। ভাই আমাদের যদি কোথাও কোনো ত্রুটি থাকে তবে বলেন। চলুন আমরা একদিন বসে চা খাই এবং খোলামেলা কথা বলি। বেসরকারি ভূমি উন্নয়ন বিধিমালা-২০০৪ অনুযায়ী, কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সংশ্লিষ্ট বেসরকারি প্রকল্প অনুমোদনের আগে প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকার কোনো প্লট বা ভূমি বা ইমারত বিক্রয় বা বরাদ্দ প্রদানের জন্য কোনো বিজ্ঞাপন প্রকাশ বা প্রচারকার্য করা যাবে না। এবং প্রকল্প সংক্রান্ত যে কোনো সাইনবোর্ড, বিজ্ঞাপন প্রচার বা যোগাযোগপত্রে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত অনুমোদন নম্বর উল্লেখ করতে হবে। অন্যদিকে রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন-২০১০-এ বলা হয়েছে, কোনো ডেভেলপার কর্তৃপক্ষ কর্তৃক রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন এবং ডেভেলপার কর্তৃক হস্তান্তর দলিল সম্পাদনের ক্ষমতা বা অধিকার প্রাপ্তির আগে রিয়েল এস্টেট ক্রয়-বিক্রির জন্য প্রকল্পের বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমে প্রচার করতে পারবে না। প্রকল্প অনুমোদনের আগে ক্রেতার কাছে ডেভেলপার কোনো রিয়েল এস্টেট বিক্রি করতে বা বিক্রির জন্য চুক্তিবদ্ধ হতে পারবে না। প্রত্যেক ডেভেলপার ক্রেতাকে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ও সংশ্লিষ্ট জমির মালিকানা সংক্রান্ত দলিলপত্র প্রদর্শন করবে। ডেভেলপার কোম্পানি এ আইন ভঙ্গ করলে দুই বছর কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তবে নর্থসাউথ গ্রিনসিটি আইন ভঙ্গ করে প্রয়োজনীয় অনুমোদন ছাড়াই সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমে প্রচারণা ও জমি বিক্রি করছে।
এদিকে নর্থসাউথ গ্রিনসিটি যে জমি আবাসিক প্লট হিসাবে বিক্রি করছে, এর অধিকাংশ জলাধার ও কৃষিজমি। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ৬(ঙ) ধারায় বলা হয়েছে, জলাধার হিসাবে চিহ্নিত জায়গা ভরাট বা অন্য কোনোভাবে শ্রেণি পরিবর্তন করা যাইবে না : তবে শর্ত থাকে যে, অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থে অধিদপ্তরের ছাড়পত্র গ্রহণক্রমে জলাধার সম্পর্কিত বাধানিষেধ শিথিল করা যাইতে পারে। এই ধারা লঙ্ঘনে প্রথম অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক ২ (দুই) বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক ২ (দুই) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে অন্যূন ২ (দুই) বৎসর, অনধিক ১০ (দশ) বৎসর কারাদণ্ড বা অন্যূন ২ (দুই) লক্ষ টাকা, অনধিক ১০ (দশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। স্থানীয়রা বলছেন, বেশির ভাগ জমিই তাদের কেনা নয়। শুধু ছবি দেখিয়ে জমি বিক্রি করছে। কাউকে লোকেশন বুঝিয়ে দিতে পারছে না।