দেশে কিডনি রোগী দুই কোটিরও বেশি। প্রতিবছর ৩৫ থেকে ৪০ হাজার মানুষ কিডনি বিকলের শিকার হচ্ছে। যাদের বেঁচে থাকার জন্য ডায়ালাইসিস ও কিডনি সংযোজন একমাত্র উপায়। সরকারি-বেসরকারিভাবে এখন পর্যন্ত ১৮০০ রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে। তবে কিডনি চিকিৎসায় একমাত্র সরকারি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউিট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি’ (নিকডু) বিশ বছরে মাত্র চল্লিশজনের কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট সম্পন্ন হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিডনির চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় শতকরা ১০জন এটা বহন করতে পারে। অনেক পরিবার আর্থিকভাবে নিঃস্ব হয়ে যায়। নিকডুতে কিডনি প্রতিস্থাপন সুবিধা না থাকায় রোগীরা বিপাকে পড়ছেন।
বিশ্বব্যাপী কিডনি রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব নেফ্রোলজি প্রতিবছর মার্চ মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার কিডনি দিবস পালিত হয়। বাংলাদেশেও আজ (বৃহস্পতিবার) পালিত হচ্ছে বিশ্ব কিডনি দিবস-২০২৩। এবারের প্রতিপাদ্য- ‘কিডনি হেলথ ফর অল : প্রিপেয়ারিং ফর দ্য আন-এক্সপেক্টেড, সাপোর্টিং দ্য ভালনেরাবল’ অর্থাৎ ‘সুস্থ্য কিডনি সবার জন্য-অপ্রত্যাশিত দুর্যোগের প্রস্তুতি, প্রয়োজন ঝুঁকিপূর্ণদের সহায়তা।’ বিশ্বব্যাপী ৮৫ কোটি মানুষ বিভিন্ন ধরনের কিডনি জটিলতায় আক্রান্ত। বিশ্বে রোগটিতে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে ২৪ লাখ।
প্রতিপাদ্যে রোগীদের নিরবচ্ছিন্ন সেবার প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরা হয়েছে। প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম, স্থানীয় বা বৈশ্বিক দুর্যোগে এসব রোগীরা অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতির শিকার হন। তাই যে কোনো ধরনের দুর্যোগে তাদের নিরবচ্ছিন্ন চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে নীতিনির্ধারকদের প্রস্তুতিমূলক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণে জোর দেওয়া হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়- নিকডুর একজন অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক পাশেই ব্যক্তি উদ্যোগে কিডনি হাসপাতাল গড়ে তুলেছেন। তিনি সপ্তাহে গড়ে চারজনের কিডনি প্রতিস্থাপন করছেন। ২০০৭ সাল থেকে শ্যামলীর এই (সেন্টার ফর কিডনি ডিজেজ অ্যান্ড ইউরোলজি) হাসপাতালে ১৪০০’র মতো ট্রান্সপ্লান্ট সম্ভব হয়েছে। অথচ ২০০৩ সালে নিকডু প্রতিষ্ঠা হলেও মাত্র ৪০টির মতো কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
১৯৯৮ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে, বারডেমে ২০০৪ এবং ঢাকা মেডিকেলে ২০১০ সাল থেকে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হয়। প্রায় সবগুলোতেই নিয়মিত হচ্ছে। সামরিক হাসপাতালগুলোতে নিয়মিত হচ্ছে। এর বাইরে বেসরকারিভাবে ২০০৬ সাল থেকে মিরপুর কিডনি ফাউন্ডেশন, পপুলার, ল্যাবএইড, ইউনাইডেটড ও এভার কেয়ার হাসপাতালে প্রতিস্থাপন হচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা যায় কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রধান পরীক্ষা টিস্যু টাইপিং টেস্ট। কিডনিদাতা ও গ্রহীতার রক্তের গ্রুপ থেকে শুরু করে আরও কিছু বিষয় ম্যাচ করতে পরীক্ষাটি করা হয়। নিকডু প্রতিষ্ঠার পর টিস্যু টাইপিংয়ের পৃথক কক্ষ রয়েছে। যেটি এখন পর্যন্ত চালু হয়নি। রোগীর উপযোগী ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক আইসিইউ নেই হাসপাতালটিতে।
হাসপাতাল পরিচালক অধ্যাপক ডা. বাবরুল আলম যুগান্তরকে বলেন, ‘কিডনি চিকিৎসায় একমাত্র সরকারি ইনস্টিটিউটে প্রতিস্থাপন কার্যক্রম গতিশীল হওয়া উচিত ছিল। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর একটি ডেডিকেটেড টান্সপ্লান্ট ইউনিট করছি। সপ্তাহের প্রতি শনিবার অন্তত একটা কিডনি প্রতিস্থাপনের ঘোষণা দিয়েছি। রোগীরা সিরিয়াল দেওয়া শুরু করেছে। প্রতিদিন বহির্বিভাগে ১০ থেকে ১২ জন প্রতিস্থাপনের জন্য যোগাযোগ করছে। পূর্ণাঙ্গভাবে ট্রান্সপ্লান্ট চালুর জন্য প্রস্তুত করছি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম চাওয়ার পর তিনি নিজ উদ্যোগে যন্ত্রপাতি দিতে চেয়েছেন।’
হাসপাতালের আরেক চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. কাজী শাহনূর আলম দাবি করেন, কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য ডেডিকেটেড টিম থাকতে হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য এখন পর্যন্ত ফুল ডেডিকেটেড টিম তৈরি করতে পারিনি। একটি টিমে ট্রান্সপ্লান্ট সার্জন, অ্যাসিটেন্ট, ট্রান্সফিউশন জনবল ও দক্ষ নার্স লাগে। এখানে যখন কাউকে তৈরি করা হয়েছে, তখনই তিনি অন্য কোথাও চলে গেছেন।
চিকিৎসকরা আরও জানান, এখানে কিডনি প্রতিস্থাপনে কোনো খরচ লাগে না। তবে পোস্ট ট্রান্সপ্লান্ট মেডিকেশন সরবরাহ না থাকায় কিছু অর্থ ব্যয় হয়। হিসাব করে দেখা গেছে একজন রোগী একলাখ টাকার প্রস্তুতি নিয়ে আসলেই ট্রান্সপ্লান্ট ও ১৪ দিনের ওষুধসহ সবকিছু দেওয়া সম্ভব। ৬ মাস পর্যন্ত সাড়ে তিনলাখ টাকার মতো খরচ লাগে। যাদের এন্টিবডি, ইনডাকশন থেরাপিসহ বায়োলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন হবে, তাদের কিছু বেশি খরচ হয়।
কিডনিরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ বলেন, দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ একটি নীরব ঘাতক। এ রোগের ঝুঁকি এড়াতে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় পরিবর্তন অবশ্যক। এজন্য নিয়মিত ব্যায়াম ও সক্রিয় থাকা। স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা। ধূমপান পরিহার করা, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন না করা। স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তদের নিয়মিত কিডনির কার্যকারিতা পরীক্ষা করা।
দিবসটি উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশন সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে। এরমধ্যে আজ জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউিটে সকাল ৮টায় শোভাযাত্রা, পরিপত্র বিতরণ ও আলোচনা সভা হবে। সকাল সাড়ে ১০টায় বিএসএমএমইউতে আলোচনা সভা হবে। বেলা ১১টায় ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে র্যালি স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম ও সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। মগবাজারের ইনসাফ বারাকাহ হাসপাতাল প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত স্বল্প ও বিনামূল্যে চিকিৎসা দিচ্ছে। ১৫ মার্চ পর্যন্ত এই সুযোগ থাকবে।