দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। দিন যত গড়াচ্ছে এই খাতে নারীর অংশগ্রহণ, অবদান বাড়ছে। গ্রাফিকস, কল সেন্টারের কাজ পেরিয়ে প্রোগ্রামিং, ডেটা সায়েন্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট অব থিংসে (আইওটি) নারীর আগ্রহ বাড়ছে। সাধারণ, করপোরেট, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে আইটি বিভাগে বর্তমানে একাধিক নারীকে কাজ করতে দেখা যায়।
আর প্রযুক্তি ব্যবসায় নারীর অংশগ্রহণ কয়েক বছর আগেই শুরু হয়েছে। সেসব ক্ষেত্রে নারীরা ভালো করছেন বলেই জানা গেছে। সেই ভালোর ধারাবাহিকতায় তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্বে এসেছেন নারীরা। সংখ্যায় যেমন এটা বাড়ছে, তেমনি একটা সংগঠনকে শক্ত ভিত্তি দিতেও কঠোরভাবে কাজ করছেন তারা।
দেশের কয়েকটি সংগঠনের নেতৃত্বে আছেন নারী। একাধিক সংগঠনের বিভিন্ন পদে নারীরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ভালোভাবেই সামলাচ্ছেন। খাত সংশ্লিষ্টরা অন্তত তাই বললেন।
এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. লাফিফা জামাল নারী দিবসের প্রাক্কালে বলেছেন, স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে নারীর অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে তাদের শিক্ষার হার বাড়াতে হবে। গ্রাম ও শহরে পুরুষের তুলনায় নারীরা শিক্ষার দিক থেকে এখনও পিছিয়ে। বর্তমানে ৩০ শতাংশ নারী শুধু আইটি নিয়ে পড়াশোনা করে। দেশে ১২ শতাংশ নারী আইটি প্রফেশনাল রয়েছেন। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে নারীর অনেক ভূমিকা রয়েছে। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীরা যাতে আইটিতে পড়াশোনা করতে পারে সেজন্য তাদের বেশি করে বিভিন্ন সুযোগ করে দিতে হবে।
বাংলাদেশ উইমেন ইন টেকনোলজির (বিডাব্লিউআইটি) সভাপতি রেজওয়ানা খান নারী দিবস, দিবসটির প্রতিপাদ্য, সমতার বিষয়ে বলেন, জন্মের শুরুতেই একটি মেয়ের ইকুয়ালিটি নিশ্চিত করতে হবে। জন্মগ্রহণের পর একটা মেয়ের পড়াশোনা করার অধিকার-তার স্টেমে পড়াশোনা করতে পারা, লাইফের প্ল্যানিংটা করতে পারা- সবকিছুর মধ্যে একটা ইকুয়ালিটি আছে। এই জার্নিটা যখন আমরা জন্ম নিই তখন থেকেই শুরু হয়। এটা (জাতিসংঘের প্রতিপাদ্য) খুবই সময়োপযোগী একটা থিম। আমরা নিজেরা স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে যাচ্ছি। সব মেয়েরই এখানে ইনপুট দেওয়ার আছে। তা না হলে স্মার্ট বাংলাদেশ হবে না। তিনি আরও বলেন, দেশের অর্ধেক জনসংখ্যাই নারী। সেই নারীরা যদি অংশ না নেয় তাহলে স্মার্ট বাংলাদেশ হবে না। সবাইকে এখানে রাখতে হবে। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে যাচ্ছি। আল্টিমেটলি এটা খুবই কার্যকরী একথা থিম। এটা দীর্ঘমেয়াদি একটা ব্যাপার, আমাদের ভাবনার মধ্যেই ছিল যে কোনও মেয়ের জন্মের শুরু থেকেই যেন তার অধিকারটা শুরু হয়ে যায়। ইকুয়ালিটিটা যেন নিশ্চিত হয়।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সামিরা জুবেরি হিমিকা নারী দিবস প্রসঙ্গে বলেন, ‘এ পর্যায়ে আসতে উদ্যোক্তা, ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন লিডার এবং সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ভঙ্গকারী একজন নারী হিসেবে আমাকে অনেক বাধা এবং চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এত বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে যা বর্ণনাতীত। কিন্তু আমি আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদা নিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়েছি। কোনও ধরনের নেতিবাচকতা আমাকে আমার স্বপ্ন, জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। আপনাদের ক্ষেত্রে কী বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে- তিনি প্রশ্ন করেন। আপনারা সাহসী, উদ্যমী। আপনাদের সম্ভাবনা সীমাহীন। অতএব থেমে গেলে চলবে না।’
উইমেন ইন ডিজিটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী আছিয়া নীলা বলেন, ‘নারীর এই পরিবর্তনকে অবশ্যই আমরা ইতিবাচকভাবে দেখি। আমরা যখন শুরু করেছিলাম তখন এই পেশায় ১-২ জন ছিলেন। এখন সংখ্যা অনেক বেড়েছে। আমরা ডিজিটাল অর্থনীতিতে অবদান রাখছি। আগে নারীরা কল সেন্টারে কাজ করতেন। গ্রাফিক ডিজাইন করতেন। আর এখন হাইটেক কাজ করছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, মোবাইল অ্যাপস ডেভেলপমেন্ট, ডেটা সায়েন্স নিয়ে কাজ করছেন।’
তিনি অতীতের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘আগে কোনও আইটি কোম্পানির প্রোগ্রামিং বিভাগের দুই একজন নারী দেখা গেলেও বর্তমানে তার সংখ্যা ১০ জনের অধিক। কোনও কোনও আইটি কোম্পানিতে নারীর সংখ্যা ৪০ শতাংশের বেশি দেখা যাচ্ছে।’ আছিয়া নীলা জাতিসংঘের এই প্রতিপাদ্যকে যুগোপোযোগী বলে অভিহিত করে বলেন, ‘দেশে নারীর সংখ্যা প্রায় অর্ধেক। এর ৫০ শতাংশও যদি আইটিতে আনা যায় তাহলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে।’ যদিও এই প্রক্রিয়াটি আরও আগেই শুরু হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ওমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ট্রাস্টের (উই) সভাপতি ও ই-ক্যাবের যুগ্ম সম্পাদক নাছিমা আক্তার নিশা বলেন, ‘নারীদের সামগ্রিক পবিবর্তনটা ভালো। দেশের জন্য ভালো কিছু নিয়ে এসেছে। কোভিডের সময় নারীরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে উদ্যোক্তা হয়েছেন। তারা জুম ব্যবহার করে মিটিং করেছন। স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে নারীদের অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে হবে। তাহলে স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়ন হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে নিশা বলেন, ‘সবার আগে আমাদের পরিবারকেন্দ্রিক বাধা পেরোতে হবে। কিছু কিছু পরিবার এখন চেষ্টা করছে বাড়ির মেয়েটিকে সাপোর্ট করতে। আবার অনেক জায়গায় বাধা দেওয়া হচ্ছে। তবে ইদানিং সাপোর্ট করার হার বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে। দেখা গেছে অনেক স্বামী তার স্ত্রীর প্রতিষ্ঠানের পণ্যের ডেলিভারি দেওয়ার কাজ করছেন। এই সাপোর্টটা উঠে দাঁড়াতে ভীষণ দরকার।’ প্রসঙ্গত, উই হলো দেশের প্রায় ১৪ লাখ নারী উদ্যোক্তার একটি প্ল্যাটফর্ম।
বাংলাদেশ আইসিটি জার্নালিস্ট ফোরামের (বিআইজেএফ) সভাপতি নাজনীন নাহার তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক বিটের সাংবাদিক সংগঠনের প্রথম নারী সভাপতি। যদিও তিনি নিজেকে নারী সভাপতি হিসেবে দেখেন না। সংগঠনের একজন সদস্য মনে করেন বলে জানান।
তিনি বলেন, ‘সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরে গ্রহণযোগ্যতার জায়গায় প্রথম প্রথম সমস্যা হতো। এখন ঠিক হয়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইন্ডাস্ট্রি থেকে সবার সহযোগিতা পেয়েছি, উৎসাহ পেয়েছি। এই শিল্পের অনেকেই আমাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এটা আমার জন্য একটা ইতিবাচক দিক। যদিও এসব নিয়ে অনেক সংশয় ছিল। এখন নেই। কেটে গেছে। তিনি মনে করেন নারীরা যেহেতু ধৈর্যশীল, ফলে তাদের ভালো করার সম্ভাবনা বেশি। তিনি বলেন, আমাদেরকে আগে মানুষ ভাবা হোক, পরে নারী।’