বাংলাদেশের বিভিন্ন সম্ভাবনাময় খাতে ১০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। তুলনামূলক কম মজুরি, বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন, অর্থনৈতিক অঞ্চলের সুবিধার পাশাপাশি সরকারের বিনিয়োগ সহায়ক নীতি থাকায় এ সুযোগ কাজে লাগানো সম্ভব। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই আয়োজিত বাংলাদেশ বিজনেস সামিটের দ্বিতীয় দিনের মূল অধিবেশনে সরকারি নীতিনির্ধারক এবং দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা এমন মত দিয়েছেন।
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এ অধিবেশনের বিষয় ছিল ‘প্রধান খাতগুলোতে বিনিয়োগের সুযোগ’। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। এতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। নতুন বিনিয়োগের জন্য কর অবকাশ সুবিধা আছে। শূন্য শুল্কে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করা যায়। রপ্তানির জন্য প্রণোদনা রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ওয়ানস্টপ সার্ভিস রয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক। এর পাশাপাশি পাট ও পাটপণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত, প্লাস্টিক এবং সেবা রপ্তানি খুবই সম্ভাবনাময়।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, পদ্মা সেতু, পদ্মা রেলওয়ে সেতু, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের মতো বড় প্রকল্প বাংলাদেশে বিনিয়োগ আনতে সহায়তা করবে। বাংলাদেশকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে নিয়ে যাবে।
মূল প্রবন্ধে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা গড়া। তাঁর কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এরই মধ্যে মধ্যম আয়ের ক্যাটাগরিতে। বর্তমান সরকারের স্বপ্ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে উন্নীত হওয়া। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চমৎকার প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে এবং একটা বড় রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বেসরকারি খাতকে সহায়তার সরকারি নীতি অসাধারণ সাফল্য বয়ে এনেছে। বাংলাদেশের সাফল্যের অন্যতম কারণ নারীর ক্ষমতায়ন। এর ফলে বড় ধরনের সামাজিক পরিবর্তন হয়েছে। তৈরি পোশাকশিল্প এ ক্ষেত্রে বড় অবদান রেখেছে।
বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের উদ্ধৃতি দিয়ে সালমান এফ রহমান বলেন, বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে নবম বৃহত্তম ভোক্তাবাজারে পরিণত হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের তিন কোটি মানুষ মধ্যম এবং বিত্তশালী শ্রেণির মধ্যে পড়বে। সুতরাং বাংলাদেশে বিনিয়োগ শুধু রপ্তানির উদ্দেশ্যে করতে হবে, তা নয়। এখানে খুব বড় স্থানীয় বাজার গড়ে উঠছে। ইতোমধ্যে অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী স্থানীয় বাজার লক্ষ্য করেই বিনিয়োগ করেছেন। বাংলাদেশ চীন ও ভারতের মতো বড় দুটি বাজারের মাঝামাঝি আছে। দুটি দেশেই বাংলাদেশের অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা রয়েছে। ফলে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করলে শুধু এ দেশের বাজার নয়; পার্শ্ববর্তী বড় বড় বাজার ধরার সুযোগ রয়েছে। এ দেশের শ্রমের জন্য খরচ এবং বিভিন্ন ইউটিলিটি ব্যয় তুলনামূলক কম।
তিনি বলেন, অবকাঠামোতে ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা যোগ হয়েছে। সরকার উদ্যোক্তাদের সুবিধার জন্য অবকাঠামোতে ৪০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে। ফলে কানেক্টিভিটির উন্নতি হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের জন্য ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠছে। অনেক অবকাঠামো নির্মিত হচ্ছে এবং বেশ কয়েকটি চলমান। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে। ইতোমধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হয়েছে। মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল হয়েছে। পদ্মা রেল সংযোগ সেতু শেষ হওয়ার পথে। মেট্রোরেলের কাজ শেষ হয়েছে। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে। চট্টগ্রামের সঙ্গে কক্সবাজারের রেলওয়ে যোগাযোগ গড়ে তোলা হচ্ছে। এ ছাড়া মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর হলে তা হবে প্রকৃত অর্থেই ‘গেম চেঞ্জার’।
সম্মানিত অতিথি হিসেবে যুক্তরাজ্যের প্রতিমন্ত্রী (ইন্দো-প্যাসিফিক) অ্যান মারি বলেন, তাঁর দেশের অনেক কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী। শিক্ষা এবং আর্থিক খাতে তাঁদের আগ্রহ বেশি। যাঁরা বিনিয়োগ করেছেন, তাঁরা বিনিয়োগ সম্প্রসারণে আগ্রহী। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের প্রচুর সুযোগ রয়েছে। বিনিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের নিয়মিত আলোচনার দরকার বলে তিনি মন্তব্য করেন।
অধিবেশনের সভাপতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া বলেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। আর পৃথিবীর মধ্যে ৩৫তম। বাংলাদেশের লক্ষ্য এশিয়ার বৃহত্তম ম্যানুফ্যাকচারিং এবং ডিজিটাল কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়া। এ দেশে ১৭ কোটি মানুষের বিশাল বাজার রয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ১০০ কোটি মানুষের বাজারে পণ্য বিক্রির সুযোগ রয়েছে। এ দেশে ১০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে এবং তিনি আশা করেন, বিনিয়োগকারীরা তাঁদের রিটার্ন পাবেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বড় মাপের বন্দর রয়েছে। ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে। উন্নত ব্যবসা পরিবেশ এবং সহজ রেগুলেশনের কারণে বাংলাদেশ বিনিয়োগকারীদের স্বপ্নের গন্তব্যে পরিণত হবে।
এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি এ. কে. আজাদ বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগে খরচ কম। প্রতিযোগী অনেক দেশের তুলনায় এ দেশে শ্রমের মজুরি কম। পানি ও বিদ্যুতের জন্য খরচ কম। প্রধানমন্ত্রী ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর মধ্যে অন্তত ১০টিতে উৎপাদন শুরু হয়েছে। তিনি নিজে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে ১০০ একর জমি নিয়েছেন উল্লেখ করে বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের জন্য সব সেবা একসঙ্গে পাওয়া যাচ্ছে। জমি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সুবিধা রয়েছে। ফলে অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের প্রচুর সুযোগ রয়েছে। তিনি সরকারের প্রতি অনুরোধ করেন, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের সঙ্গে একটি কনটেইনার বন্দর গড়ে তুললে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরে সেখান থেকে সরাসরি পণ্য যেতে পারবে। এ ধরনের আরও কিছু পদক্ষেপ নিতে পারলে ১০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব। তিনি তৈরি পোশাক খাতে ম্যান মেইড ফাইবারে বিনিয়োগের সুপারিশ করেন।
ইয়াংওয়ান করপোরেশনের চেয়ারম্যান কোরিয়ার উদ্যোক্তা কি হাক সুন বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে তাঁরা খুশি। কোরিয়ার চেয়ে বাংলাদেশে আমার বন্ধুর সংখ্যা বেশি। তিনি উল্লেখ করেন, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে তাঁরা এখন ম্যান মেইড ফাইবারের দিকে মনোযোগ বাড়িয়েছেন। তাঁরা বিদ্যুতের জন্য সৌরবিদ্যুতের ওপর নির্ভরতা বাড়িয়েছেন। তিনি বলেন, কাঁচামালের সরবরাহ চেইনের জন্য নিজেদের ওপর নির্ভর করতে হবে। তুলানির্ভর পোশাক রপ্তানি থেকে বৈচিত্র্যের দিকে যেতে হবে। তিনি মনে করেন, বিনিয়োগ নিয়ে সরকারের নীতি সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের পূর্ণ ধারণা থাকা এবং নীতির সঠিক বাস্তবায়ন খুব জরুরি। চীন ও ভিয়েতনামের মতো দেশের জন্য প্রতিযোগিতার জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়া সহজ হতে হবে।
মারুবিনি এশিয়ার আঞ্চলিক সিইও তাকেশি মায়া বলেন, বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের প্রধান ইস্যু হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তা। ইমিগ্রেশন ও কাস্টম রেগুলেশনের আরও উন্নতি করতে হবে। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্ভাবনা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এ দেশের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে।
কোরিয়া ট্রেড ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন এজেন্সির গ্রিন গ্রোথ বিভাগের মহাপরিচালক জং অন কিম বলেন, সাত হাজারের বেশি কোম্পানি ভিয়েতনামে বিনিয়োগ করেছে। বাংলাদেশেও তাদের বড় বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। কোরিয়ান অনেক কোম্পানি চীন থেকে স্থানান্তর করছে। বাংলাদেশ তাদের বিনিয়োগ আনার চেষ্টা করতে পারে। এর জন্য বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি করতে হবে।
কমনওয়েলথ এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কাউন্সিলের প্রধান নির্বাহী রোজি গ্লেজব্রুক বলেন, তাঁরা কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের চেষ্টা করছেন।