ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ দেশের ব্যস্ততম রেলপথগুলোর একটি। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজের জন্য গত বছরের ৪ ডিসেম্বর থেকে এ রেলপথে বন্ধ রয়েছে ট্রেন চলাচল। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকার কমলাপুর থেকে পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া স্টেশন পর্যন্ত তিনটি সমান্তরাল রেলপথ নির্মাণকাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এক সপ্তাহের মধ্যে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের মধ্যে পুনরায় ট্রেন চলাচল শুরুর প্রত্যাশা করছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, রেলের ডাবল লাইনের কাজ শেষ হলে প্রতিদিন এই পথে ৫০ বার ট্রেন আসা-যাওয়া করতে পারবে। যানজট এড়িয়ে নিরাপদে ও কম খরচে যাতায়াতের সুযোগ পাবেন যাত্রীরা।
তবে পদ্মা সেতুর সংযোগ রেলপথের কাজ শেষ করে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে পুনরায় ট্রেন চলাচল শুরু হলেও রেলপথটির গেন্ডারিয়া থেকে চাষাঢ়া পর্যন্ত অংশের কাজ এখনো চলমান। এ কাজ সময়মতো শেষ করা নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। এমন প্রেক্ষাপটে ট্রেন চলাচল শুরু হলেও আপাতত দৈনিক চলাচল করা ট্রেনের সংখ্যা বাড়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিন প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রেলপথটির উন্নয়নকাজ শুরু হয়েছে কমলাপুরের শহরতলি প্লাটফর্ম থেকে। সদ্য বিছানো পাথরের ওপর ক্রেন দিয়ে নামানো হচ্ছে একের পর এক স্লিপার। স্লিপারগুলো তৈরি করেছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ, যারা সিআরইসি নামেই বেশি পরিচিত। রেললাইনের পাশাপাশি ঢেলে সাজানো হচ্ছে শহরতলি প্লাটফর্ম। ঢালাই দিয়ে বসানো হচ্ছে টাইলস। পুরো প্লাটফর্ম এখন নানা ধরনের নির্মাণসামগ্রী, ফেলে রাখা স্লিপারসহ আনুষঙ্গিক উপকরণের দখলে।
কমলাপুরের শহরতলি প্লাটফর্ম থেকে গেন্ডারিয়া পর্যন্ত পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে ডুয়াল গেজের তিনটি রেলপথ। এ রেলপথের কমলাপুর-গেন্ডারিয়া অংশের কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। সামনের সপ্তাহেই ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের মধ্যে ফের ট্রেন চলাচল শুরুর প্রত্যাশা করছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বন্ধ হওয়ার আগে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের মধ্যে প্রতিদিন নয় জোড়া ট্রেন চলতে পারত। আমরা এই রেলপথটি ডাবল লাইনে উন্নীত করছি। এ কাজ শেষ হওয়ার পর ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের মধ্যে প্রতিদিন ৫০ জোড়া ট্রেন চলাচল করতে পারবে।’
রেলপথে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের দূরত্ব ১২ কিলোমিটারের সামান্য বেশি। দেশের ব্যস্ততম এ সেকশনে ব্রিটিশ আমলে তৈরি একটি মিটার গেজ রেলপথ দিয়ে ট্রেন পরিচালিত হয়ে আসছিল। ক্রমবর্ধমান যাত্রী চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে ২০১৪ সালে সেকশনটিতে আরেকটি রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ রেলওয়ে। উদ্দেশ্য, দুটি লাইন দিয়ে নির্বিঘ্নে ট্রেন চালানো। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত। পরে তা ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। তবে এখনো প্রকল্পের কাজ বাকি রয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। এমন প্রেক্ষাপটে প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর জন্য পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব করেছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে। কিন্তু এ প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
‘ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেকশনে বিদ্যমান মিটার গেজ রেললাইনের সমান্তরালে একটি ডুয়াল গেজ রেললাইন নির্মাণ’ প্রকল্পের মূল কাজগুলো করা হচ্ছে তিনটি প্যাকেজে। একটি প্যাকেজে ১২ দশমিক ১০ কিলোমিটার মূল রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। এর সঙ্গে ৫ দশমিক ১০ কিলোমিটার লুপ রেলপথ, পাঁচটি স্টেশন ভবন আর ১১টি সেতু কালভার্ট তৈরি করা হচ্ছে। মাঠপর্যায়ে কাজগুলো বাস্তবায়ন করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পাওয়ার কনস্ট্রাকশন অব চায়না লিমিটেড।
রেলপথের কাজ শেষ করার পর দ্বিতীয় প্যাকেজে করা হবে সিগন্যালিংয়ের কাজ, যা বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এলএস ইলেকট্রিক লিমিটেড।
২০১৭ সালের জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রকল্পের ভৌত কাজ শুরুই হয় ওই বছরের আগস্টে। কাজ বিলম্বিত হওয়ার কারণ হিসেবে রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্প এলাকায় প্রচুর অবৈধ স্থাপনা ছিল, যেগুলো পর্যায়ক্রমে উচ্ছেদ করা হয়। কাজ শুরুর পরও কয়েকটি এলাকায় জটিলতা দেখা দেয়। ১৩টি রিট মামলা, নারায়ণগঞ্জ স্টেশনে ডাউন ফেসিং পয়েন্টের কাছে ৩৩০ মিটার এলাকায় ডাবল লাইনের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা না পাওয়াসহ নানাবিধ কারণে নির্মাণকাজ বিলম্বিত হয়।
এদিকে প্রকল্পটির ৪০ শতাংশ কাজ অসমাপ্ত রেখেই রেলওয়েকে চুক্তি সমাপ্তির নোটিস দিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়না লিমিটেড। কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি যথাসময়ে পাওনা পরিশোধ না করা, অতিরিক্ত কাজের মূল্য পরিশোধ না করা এবং প্রকল্পের সাইট বুঝে না পাওয়াকে দায়ী করেছে।