১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ০৯:১৬:১৬ অপরাহ্ন
এসএসসিতে বসছে না রাজশাহী বোর্ডের সাড়ে ২৯ হাজার পরীক্ষার্থী
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৪-০৬-২০২২
এসএসসিতে বসছে না রাজশাহী বোর্ডের সাড়ে ২৯ হাজার পরীক্ষার্থী

রেজিস্ট্রেশন করেছে কিন্তু এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ করেনি রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের ২৯ হাজার ৮৮০ জন শিক্ষার্থীর। ফলে, তারা ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের এসএসসি পরীক্ষায় বসছে না। রেজিস্ট্রেশন করেও এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ না করা পরীক্ষার্থীর সংখ্যায় শীর্ষে বগুড়া এবং নিম্নে জায়পুরহাট জেলা। শিক্ষার্থীরা ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ও ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন।

রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড বলছে, এসএসসি পরীক্ষা শেষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চিঠি দেয়া হবে। জানতে চাওয়া হবে পরীক্ষার্থী ফরম পূরণ না করার কারণগুলো। বিভিন্ন স্কুলের প্রধান শিক্ষকরা বলছেন, করোনার সময় শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। করোনার দুই বছরে অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। আবার কেউ কেউ স্বজনও হারিয়েছেন। এদের মধ্যে কেউ আবার অর্থের অভাবে পড়াশোনা বাদ দিয়ে জীবিকার তাগিদে কাজ করছেন। এতে ফরম পূরণ করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে।

রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. আরিফুল ইসলাম এসএসসির কেন্দ্র সচিবদের সাথে মতবিনিময় সভায় জানান, এবছর এসএসসি পরীক্ষায় বসবে ১ লাখ ৯৬ হাজার ৬০০ জন শিক্ষার্থী। ছাত্র ১ লাখ ১ হাজার ৫৩৫ জন এবং ছাত্রী ৯৫ হাজার ৬৫ জন। এরমধ্যে বিজ্ঞান বিভাগের ৮৭ হাজার ৬৮৪ জন, মানবিক ৯৯ হাজার ৫৮২ জন এবং ব্যবসায় শিক্ষায় ৯ হাজার ৩৩৪ জন শিক্ষার্থী। রাজশাহী বিভাগের অধীন ৮টি জেলার মোট পরীক্ষার কেন্দ্র সংখ্যা ২৭০টি। আর প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২ হাজার ৬৭৬টি। এবছর নিবন্ধিত মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ লাখ ১৬ হাজার ১৩১জন। ফরম পূরণ করেছে ১ লাখ ৮৬ হাজার ২৫১জন। ২৯ হাজার ৮৮০জন শিক্ষার্থী ফরম পূরণ করেনি।

পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বলেন, ২৯ হাজার ৮৮০ জন শিক্ষার্থী ফরম পূরণ করেনি। তারা কেনো ফরমপূরণ করলো না এটি জানা অনুসন্ধানের ব্যাপার। করোনার ব্যপার ছিল। অনেকেই অটোপাসের কথা ভেবেছে।

রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের একটি সূত্র জানায়, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে রাজশাহী জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে রেজিস্ট্রেশন করেছে ৩৩ হাজার ৩১৪ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ফরম পূরণ করেনি ২ হাজার ৫৪৫ জন শিক্ষার্থী। ফরম পূরণ করেছে ৩০ হাজার ৭৬৯ জন শিক্ষার্থী। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় এসএসসির রেজিস্ট্রেশন করেছে ১৭ হাজার ৫৫১ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ফরম পূরণ করেনি ২ হাজার ৫১২ জন শিক্ষার্থী। ফরম পূরণ করেছে ১৫ হাজার ৩৯ জন শিক্ষার্থী।

নাটোর জেলায় এসএসসির রেজিস্ট্রেশন করেছে ২০ হাজার ৭ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ফরম পূরণ করেনি ২ হাজার ৬৮ জন শিক্ষার্থী। ফরমপূরণ করেছে ১৭ হাজার ৯৩৯ জন শিক্ষার্থী। নওগাঁ জেলায় এসএসসির রেজিস্ট্রেশন করেছে ২৬ হাজার ৮০০ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ফরম পূরণ করেনি ৩ হাজার ৪৪ জন শিক্ষার্থী। ফরম পূরণ করেছে ২৩ হাজার ৭৫৬ জন শিক্ষার্থী। পাবনা জেলায় এসএসসির রেজিস্ট্রেশন করেছে ৩২ হাজার ৫৮৫ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ফরম পূরণ করেনি ২ হাজার ৭৬৪ জন শিক্ষার্থী। ফরম পূরণ করেছে ২৯ হাজার ৮২১ জন শিক্ষার্থী।

সিরাজগঞ্জ জেলায় এসএসসির রেজিস্ট্রেশন করেছে ৩৭ হাজার ৭৭৪ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ফরমপূরণ করেনি ৩ হাজার ১৫৩ জন শিক্ষার্থী। ফরম পূরণ করেছে ৩৪ হাজার ৬২১ জন শিক্ষার্থী। বগুড়া জেলায় এসএসসির রেজিস্ট্রেশন করেছে ৩৮ হাজার ৩৮৪ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ফরম পূরণ করেনি ৩ হাজার ৩৮৭ জন শিক্ষার্থী। ফরম পূরণ করেছে ৩৪ হাজার ৯৯৭ জন শিক্ষার্থী। জয়পুরহাট জেলায় এসএসসির রেজিস্ট্রেশন করেছে ৯ হাজার ৭৩৯ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ফরম পূরণ করেনি ৮১ জন শিক্ষার্থী। ফরম পূরণ করেছে ৯ হাজার ৬৫৮ জন শিক্ষার্থী।

বিষয়টি নিয়ে রাজশাহী নগরীর একটি ও পবার দুইটি স্কুলের এসএসসির রেজিস্ট্রেশন ও ফরম না পূরণ করা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এর মধ্যে বিসিএসআইআর ল্যাবরেটরি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এ বছর ৬৮ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় বসছে। এর মধ্যে রেজিস্ট্রেশন করলে ও ফরম পূরণ করেনি ৮ জন শিক্ষার্থী। তাদের সবাই ছাত্রী।

এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৮জনের মধ্যে সাত জনের পরিবারের সদস্যের মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহ করা হয়। সেই নম্বরে যোগাযোগ করে টিয়া খাতুন, কাজল খাতুন ও রতনা খাতুনের বিয়ের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে তাদের স্বামী ও বাবা-মায়ের থেকে। এর মধ্যে চারজনের নম্বর বন্ধ ছিল। বাকি একজনকে মুঠোফোন নম্বর পাওয়া যায়নি।

বিসিএসআইআর ল্যাবরেটরি উচ্চ বিদ্যালয়ে সিনিয়র শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ ও আলমঙ্গীর হোসেন জানান, বিদ্যালয় থেকে এ বছর ৬৮ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। এর মধ্যে ৮ জন ছাত্রী রেজিস্ট্রেশন করলেও ফরম পূরণ করেনি। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে করোনা একটা বড় বিষয় ছিল। সেই সময় তাদের অনেকেরই বিয়ে হয়ে গেছে।

অন্যদিকে, রাজশাহী পাটকল উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮১ জনের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন করেছে ফরম পূরণ করেনি ৮ জন শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে পাঁচজন ছাত্রী ও তিনজন ছাত্র। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৮ জন শিক্ষার্থীর মুঠোফোন নম্বর তাদের স্কুল থেকে নেওয়া হয়। সেই নম্বরে যোগাযোগ করে মিলি খাতুন, আয়েশা আক্তার ও সানজিদার আক্তারের বিয়ের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে মিলি খাতুনের পরীক্ষা দেয়া ইচ্ছে রয়েছে। তিনি গত সপ্তাহে তার বাবাকে মুঠোফোনে জানিয়েছেন। মিলির বাবা পরীক্ষার বিষয়ে প্রধান শিক্ষকের সাথে যোগাযোগ করবে বলে জানিয়েছেন। এর মধ্যে অভাবের তাড়নায় হাসান আলী নগরীর উপকণ্ঠ কাটাখালীতে একটি ফলের দোকানে কাজে লেগেছেন। হাসান আলীর বাবা আজিম আলী জানান।

আর সামিউল ইসলামের বাবা সবুজ আলী এই স্কুলে পিয়নের কাজ করতেন। তিনি মারা যাওয়ার পরে অভাবের কারণে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে তার। অন্যদিকে, টাকার অভাবে এসএসসি পরীক্ষা দিতে পাড়ছেন না রঞ্জন দাশ। রঞ্জন দাশ দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, বাবা ধীরেন্দ্রনাথ ও মা বৃদ্ধ মানুষ। তারা বাড়িতে থাকেন। আমরা বর্তমানে নওগাঁয় নিজেদের বাড়িতে থাকি। টাকার অভাব, আর এখন থেকে রাজশাহী গিয়ে পরীক্ষা দেয়া সম্ভব না।

এ বিষয়ে রাজশাহী পাটকল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান  জানান, করোনার সময়ে শিক্ষার্থীদের ওপরে একটা বড় ধরনের ধকল গেছে। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ। তাতে করে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা থেকে সড়ে গেছে। সেসব শিক্ষার্থীদের আবার স্কুলে নিয়ে আসতে ছুটির দিনেও কাজ করতে হয়েছে শিক্ষকদের।

তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষাব্যবস্থা সমৃদ্ধ করতে কাজ করে যাচ্ছে। তার অংশ হিসেবে করোনার পরবর্তী সময়ে আবারও শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলো পুরোদমে আগের ছন্দে পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া যারা এবছর এসএসসি পরীক্ষায় বসছে তাদের শিক্ষাবর্ষ ২০২০-২০২১।

অন্যদিকে, কাটাখালি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ডাবলু জানান, ৪৭ জনের মধ্যে ২২ জন ছাত্রী রেজিস্ট্রেশন করেছে ফরম পূরণ করেনি।

ওই স্কুলের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা জানায়, ‘মেয়ে তো বিয়ে দিতেই হবে। ভালো সম্মন্ধ আর সবসময় পাওয়া যায় না। বিয়ের পরে ইচ্ছে থাকলেও পড়াশোনা হয় না মেয়েদের। শ্বশুরবাড়ি থেকে পড়াতে দিতে চায় না। ফলে বন্ধ হয়ে যায় পড়াশোনা।’

রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (মাধ্যমিক) মুঞ্জুর রহমান খান জানান, কারণ হিসেবে আমরা মনে করছি বাল্য বিয়ে, আর্থিক কারণ। তবে অর্থিক কারণ খুব একটা বেশি না। করোনার কারণে লেখাপড়ার ধারা নষ্ট হয়ে গেছে। অনেকেই পরীক্ষার প্রস্তুতি নেই। পরীক্ষার পরে আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চিঠি দেবো জানতে চাইবো কারণ। এরপরে বিষয়টি আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানাবো।

তিনি আরও বলেন, আমরা চাই না যে কোনো শিক্ষার্থী পরীক্ষা থেকে বঞ্চিত হোক। আমরা চাই সব শিক্ষার্থী পরীক্ষায় বসুক। এ বিষয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট যারা রয়েছেন তাদের শিক্ষা বোর্ডকে লিখিতভাবে জানাতে হবে; যেকেনো পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে পারলো না।

শেয়ার করুন