২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ০৫:২২:৩৮ পূর্বাহ্ন
রাজশাহীর অর্থনীতি পাল্টে দেবে আমের ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৩-০৮-২০২২
রাজশাহীর অর্থনীতি পাল্টে দেবে আমের ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট

রাজশাহী কৃষি অঞ্চলে এবার সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার আম বাণিজ্যের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছিল রাজশাহী বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। মৌসুমে স্থানীয় বাজারে আমের ভালো দাম পেয়েছেন চাষিরা ফলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হতে পারে। অপরদিকে এ অঞ্চলে যে পরিমাণ আম উৎপাদন হয়, তার তুলনায় বিদেশে রপ্তানির পরিমাণ খুব সামান্য। দেশে হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হলেও বাইরের দেশে রপ্তানি না হওয়ার কারণ আছে বেশ!


বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা আমের নায্য দাম পাচ্ছেন না চাষিরা। বেশি দামের আম দেশে চাহিদা অনেক কম। বাইরে রপ্তানি করতে না পারলে আগ্রহ হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে প্রবল। বাণিজ্যিক চাষিরা জানান, রপ্তানির আম দূষণমুক্ত করতে হয়। না হলে আম ফেরত আসার ঝুঁকি থাকে। এর জন্য দরকার ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। আবার আম বাছাইয়ের জন্য প্যাকিং হাউস ও সহজে সঙ্গনিরোধ (কোয়ারেন্টিন) সনদ পেতে কৃষি বিভাগের সঙ্গনিরোধ শাখা স্থাপন করা দরকার। যা এখন করা হয় ঢাকার শ্যামপুরের প্যাকিং হাউসে পাঠিয়ে।


ঢাকায় আম পাঠানোর পর সেখানে বাছাইয়ের সময় কিছু আম বাদ পড়ে। বাদ পড়া আমের দাম পান না চাষিরা। কমে পরিমাণ; সাথে কমে টাকা। এসব সমস্যার সমাধান করতেই রাজশাহীতে স্থাপন করা হচ্ছে ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। ফলে আম রপ্তানির দুয়ার খুলছে এবার। রাজশাহীতেই প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে সরাসরি বিদেশ যাবে এ অঞ্চলের আম। অর্থনীতি পাল্টে দেবে ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট।


কেবল আম প্রক্রিয়াজাত করেই প্ল্যান্ট থেকে মৌসুমে আয় হবে অন্তত অন্তত: কোটি টাকা। আম ছাড়াও রপ্তানির উদ্দেশ্যে শাক-সবজিও প্রক্রিয়াজাত করা যাবে এই প্ল্যান্টে। এই বিপুল কর্মযজ্ঞ এই অঞ্চলের অর্থনীতির গতি পাল্টে দেবে। এই প্ল্যান্ট স্থাপণ হলে নিরাপদ আম রপ্তানি বাড়বে। রপ্তানিকারক ও কৃষক আম রপ্তানিতে উদ্বুদ্ধ হবে। বাড়বে কর্মসংস্থান।


আমের অঞ্চল খ্যাত রাজশাহীতে ভিএইচটি নির্মাণে কৃষি মন্ত্রণালয় গুরুত্ব দিচ্ছে। রাজশাহীর পবায় ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টটি স্থাপন করবে বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। প্রায় ২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির সম্ভাব্য মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু এখন প্রকল্পটি অনুমোদন পায়নি।


বিএমডিএর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানাচ্ছে, তারা যে প্ল্যান্ট স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সেটি ঘণ্টায় ৩ হাজার কেজি ধরে দৈনিক প্রায় ৫০ টন আম প্রক্রিয়াজাত করতে সক্ষম। মৌসুমের প্রায় ৫ হাজার টন আম প্রক্রিয়াজাত করা যাবে এখানে। যার রপ্তানিমূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকার উপরে। রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের পাশে রাজশাহী বিমানবন্দর সংলগ্ন তকিপুর মৌজায় এই প্ল্যান্ট স্থাপনের কথা। এ জন্য ৬০ শতক জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন পড়বে। রাজশাহী বিমানবন্দরে কার্গো সুবিধা চালু হলে এখান থেকে সহজেই রপ্তানি করা যাবে আমসহ বিভিন্ন কৃষি পণ্য।


এই প্রকল্পটি নিয়ে কাজ করছেন বিএমডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী তরিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, এটি একটি সমন্বিত প্ল্যান্ট। একই সাথে এটি আধুনিক ও সয়ংক্রিয়। আম সংগ্রহের পর প্রথম ধাপে পরিপক্কতা যাচাই করা হয়। এরপর বিচ্ছিন্ন করা হবে বোটা। পরের ধাপে আকার অনুযায়ী বাছাই। এরপর ধৌতকরণ। এর পরের ধাপে গরম পানির ধারায় রোগ-জীবানুমুক্তকরণ। এরপর ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট। এই ধাপেরই কোয়ারেন্টাইন জীবানুমুক্তকরণ হবে। লেবেলিং বা মোড়ানোর পর চলে যাবে প্যাকেটজাতকরণে। প্রি-কুলিং এর পর আম যাবে অস্থায়ি গুদামে। সেখান থেকেই রপ্তানির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবে আম।


এটি সময়োপযোগী উদ্যোগ বলে জানিয়েছেন রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের সদ্য সাবেক প্রধান ড. আলীম উদ্দিন। তিনি বলেন, আমাদের হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট আছে। আপাতত আমরা হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট করে আম বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে থাকি। কিন্তু ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত করা আমের প্রচুর চাহিদা জাপানসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। রাজশাহীতে ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট হলে এসব দেশে আম রপ্তানির সুযোগ মিলবে। কৃষকরা আমের ভালো দাম পাবেন।


বিএমডিএর এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন বাঘার আম চুক্তিভিত্তিক আম চাষি শফিকুল হক ছানা। তিনি বলেন, রপ্তানির উদ্দেশ্যে বাগান থেকে আম ঢাকায় কোয়ারেন্টাইনে নিতে হয়। সেখান থেকে প্যাকিং হাউসে যায় আরেক জায়গায়। এরপর যায় বিমানবন্দরে। এটি একটি লম্বা প্রক্রিয়া। এতে খরচ ও ভোগান্তি বাড়ে। আমও নষ্ট হয়ে যায়। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগীতায় আমরা টিকতে পারছিনা।


একই ভাষ্য রাজশাহী এগ্রো ফুড প্রডিউসার সোসাইটির সভাপতি আনোয়ারুল হকের। সমাধান হিসেবে আম উৎপাদন এলাকায় সমন্বিত প্যাকিং হাউজ জান তিনি। পাশাপাশি রপ্তানি প্রক্রিয়া নির্বিঘ্ন করতে রাজশাহীতে কোয়ারেন্টাইন সুবিধা এবং রাজশাহী বিমানবন্দরে কার্গো সুবিধাও চান।


তিনি বলেন, ২০১৬ সালের দিকে বাগন থেকে প্যাকেটজাত হয়ে আম সোজা ঢাকায় বিমানবন্দর যেতো। সেখান থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে গেছে আম। কিন্তু ২০১৭ সাল থেকে বিড়ম্বনা শুরু। বাগান থেকে ঢাকায় কোয়ারেন্টাইন স্টেশন-প্যাকিং হাউসে নিতে গিয়ে অনেক আম নাড়াচাড়ায় নষ্ট হয়ে যায়। আবার পরিবহণ ব্যয় বাড়ে। সবমিলিয়ে আর্থিক ক্ষতির শিকার হতে হয় আমাদের।


এই আম রপ্তানিকারক বলেন, দেশের আমের জোন রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ। সরাসরি আমরা বাগান থেকে আম রপ্তানির উদ্দেশ্যে এখানেই কোয়ারেন্টইন সুবিধাসহ সমন্বিত প্যাকিং হাউস নির্মাণ করা দরকার। তাহলে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং নওগাঁর আম চাষিরা এখান থেকেই সুবিধা পারবেন।


এদিকে, গত ২৮ জুলাই রাজশাহীতে এসেছিলেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি স্থানীয় আম রপ্তানিকারকদের সাথে বৈঠক করেন। সেখানে মন্ত্রী রাজশাহীতে সমন্বিত ওয়ারহাউস নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান। এর আগে গত বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম গবেষণা কেন্দ্রে এক অনুষ্ঠানে এসে এই অঞ্চলে ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মাণের প্রতিশ্রিুতি দিয়ে যান মন্ত্রী।


ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন বিষয়ে বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রশিদ বলেন, রাজশাহী বিএমডিএর আওতাধীন এলাকা হওয়ায় বিএমডিএকে এই অঞ্চলে ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপনের উদ্যোগ নেয়ার নির্দেশ দেন কৃষিমন্ত্রী। পরে বিএমডিএ এ সংক্রান্তি একটি প্রকল্প দাখিল করে। এই প্রকল্পটি এখন পরিকল্পনা কমিশনের সবুজ পাতায়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা গেলে বিশেষ সুবিধা পাবেন এখানকার আম চাষি এবং রপ্তানিকারকরা। পাশাপাশি এই প্রকল্পের সফলতা দেখে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও এগিয়ে আসবে।


দেশে আম রপ্তানি এখনো স্থিতিশীল পর্যায়ে আসেনি বলে মন্তব্য করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের ডিন অধ্যাপক ড. ইলিয়াস হোসাইন। তিনি বলেন, মান নিয়ন্ত্রণ করে সরবরাহ ব্যবস্থা সুদৃঢ় করা দরকার। এক্ষেত্রে কৃষকদের পাশাপাশি সরকারের ভূমিকা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে উৎপাদন এবং চাহিদার একটা বিষয় থাকে। এখন যেহেতু এখন আম প্রচুর উৎপাদন হচ্ছে, সেহেতু চাষ করতে গিয়ে যে পরিমাণ খরচ হচ্ছে তা তুলতে পারেছেননা কৃষক।


এখন সরকারকে নিরাপদ আম উৎপাদন নিশ্চিত করে রপ্তানির দিকে যেতে হবে। একটা পণ্য যখন যথেষ্ট সম্ভবনার দিকে যায়, তখন সরকার সেটি নিয়ে নানামুখী উদ্যোগ নেয়। হয়তো আম নিয়ে চিন্তা-ভাবনার সময় আসছে। আম রপ্তানি করা যেতেই পারে। সেই সাথে আম প্রক্রিয়াজাতকরণ পণ্য রপ্তানির উদ্যোগ নিতে হবে। আমের অঞ্চল হিসেবে এখানে কৃষিভিত্তিক ইপিজেড স্থাপনের দাবি আমাদের দীর্ঘদিনের। সেই সাথে রাজশাহী বিমানবন্দর থেকে কার্গো বিমান চালু করা দরকার। যাতে এখান থেকেই যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষ করে আমসহ বিভিন্ন ফসল সরাসরি দেশের বাইরে যেতে পারে।


রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি দফতরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১১-১২ মৌসুমে রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় মোট আমবাগান ছিলো ৪২ হাজার ৪১৭ হেক্টর। চলতি মৌসুমে এই চার জেলায় আমবাগান দাঁড়িয়েছে ৯০ হাজার ৮৯৪ হেক্টরে। সেই হিসেবে গত এক যুগে এই অঞ্চলে আমবাগান বেড়েছে ৪৮ হাজার ৪৭৭ হেক্টর। অন্যদিকে ২০১১-১২ মৌসুমে এই চার জেলায় ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৭৩ টন আম উৎপাদন হয়েছে। চলতি মৌসুমে আম উৎপাদন হয়েছে ৯ লাখ ৫৯ হাজার ৯১৩ টন। এই চার জেলায় গত এক যুগে আম উৎপাদন বেড়েছে ৫ লাখ ৭৫ হাজার ৮৪০ টন।


আঞ্চলিক কৃষি দফতরের হিসেবে, ২০১১-১২ মৌসুমে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২৩ হাজার ২৮০, রাজশাহীতে ৮ হাজার ৯৮৬ , নওগাঁয় ৭ হাজার ৮০১ এবং নাটোরে ২ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে আমবাগান ছিলো। আর চলতি মৌসুমে আমবাগান দাঁড়িয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩৭ হাজার ১৬৫, নওগাঁয় ২৯ হাজার ৪৭৫, রাজশাহীতে ১৮ হাজার ৫১৬ এবং নাটোরে ৫ হাজার ৭৩৯ হেক্টরে।


কথা হয় রাজশাহী বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, রাজশাহীতে প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে সরাসরি বিদেশ যাবে এ অঞ্চলের আম। অর্থনীতি পাল্টে যাবে ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের কারণে। চাষিরা বেশ উপকৃত হবে। বাণিজ্যিকভাবে আম উৎপাদনের দিকে আগ্রহ বাড়বে চাষিদের। এজন্য বিভাগীয় কৃষি দপ্তরের কোন সহযোগিতা কোন চাষির প্রয়োজন হলে আমরা প্রস্তত আছি। কিংবা পরামর্শ প্রদানের জন্য যেকোন সময় চাষিরা আমাদের কাছে আসতে পারেন।

শেয়ার করুন