২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ০৮:৪৮:৪৪ পূর্বাহ্ন
খাদ্যসংকটের শঙ্কায় পৃথিবী, আশার আলো আছে কি?
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩০-০৮-২০২২
খাদ্যসংকটের শঙ্কায় পৃথিবী, আশার আলো আছে কি?

করোনা মহামারিরও আগ থেকে বিশ্বে খাদ্যসংকট ব্যাপকহারে বাড়ছিল। মহামারির পর তা আরও চরম রূপ নেয়। এরপর বিশ্ব যখন আগের অবস্থায় ফিরে আসার স্বপ্ন দেখছিল, তখনই শুরু হয় ইউক্রেন যুদ্ধ। এতে খাদ্যপণ্যের অনিশ্চয়তা কোথায় গিয়ে ঠেকে, অর্থনীতিবিদরাও তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। তাদের ধারণা, দীর্ঘসময় ধরে মানুষকে এখন উচ্চ খাদ্যমূল্যের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে।

দাতব্য সংস্থা মার্সি কোপর্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা টিজাদা ডোয়েন ম্যাককেন্না বলেন, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে পণ্যের দাম কমলেও বাজারের অস্থিরতা বহাল থাকবে। কারণ স্থানীয় বাজারগুলোতে মূল্য সমন্বয় নাও করা হতে পারে।

ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবর বলছে, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি অব্যাহত থাকবে। আর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে অস্বাভাবিক পরিশ্রম করতে হবে। বেকারত্ব ও বাজারের চলমান ধাক্কা থেকে বেরিয়ে আসতে কঠোরতর চেষ্টার কোনো বিকল্প নেই।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় গম রফতানিকারক দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেন। গেল ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে তারা যুদ্ধে লিপ্ত। এমনকি শিগগিরই তা থামবে বলেও মনে হচ্ছে না। গেল জুলাইয়ে এক টুইটবার্তায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, যুদ্ধের কারণে চলতি বছরে দেশটির খামারগুলোতে উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসতে পারে।

১৭ আগস্টের এক প্রতিবেদনে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাককিনসে পূর্বাভাস দিয়েছে, ফসল উৎপাদন মারাত্মক কমে যাবে। আগামী মৌসুমে ইউক্রেনে গমের মতো শস্য উৎপাদন ৩৫ থেকে ৪৫ শতাংশ কমে যাবে। চলমান যুদ্ধের কারণে কৃষকেরা সঠিকভাবে মাঠ প্রস্তুত, বীজ রোপণ ও সুরক্ষা এবং ফসলে সার দিতে পারছে না।

ইউক্রেন যুদ্ধ ছাড়াও ক্রমবর্ধমান জলবায়ুর প্রভাব ফসল উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আবার পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে নিজেদের পণ্য বিশ্ববাজারে বিক্রি করতে পারছে না রাশিয়া।

ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যান যারা
প্রতিটি রাতে বিশ্বের ৮২ কোটি ৮০ লাখ মানুষ পেটে ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যান। ২০১৯ সাল থেকে তীব্র খাদ্য অনিরাপত্তায় ভোগা মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে—সাড়ে ১৩ কোটি থেকে সাড়ে ৩৪ কোটি। নিজের ওয়েবসাইটে বিশ্ব খাদ্যকর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এমন তথ্যই দিয়েছে।

দুর্ভিক্ষের কিনারে গিয়ে ঠেকেছে ৪৫টি দেশের পাঁচ কোটি মানুষ। ডব্লিউএফপি বলছে, চাহিদা আকাশছোঁয়া হলেও সম্পদ তলানিতে। চলতি বছরে ১৫ কোটি ২০ লাখ মানুষের কাছে সহায়তা পৌঁছাতে বিশ্ব খাদ্যকর্মসূচির দুই কোটি ২২ লাখ মার্কিন ডলার দরকার। সংস্থাটি জানিয়েছে, আমরা একটি সন্ধিক্ষণ পার করছি। বিশ্ব যদি ক্ষুধার বিপর্যয় এড়াতে চায়, তাহলে সবাইকে সচেতনভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

খাদ্য সংকট যে কারণে
ডব্লিউএফপির মতে, চারটি অনুঘটক মিলে বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ খাদ্য-সংকট লেগে আছে। ক্ষুধার সবচেয়ে বড় একটি উৎস সংঘাত। বিশ্বের ষাট শতাংশ ক্ষুধার্ত মানুষ যুদ্ধ ও সহিংসতাপ্রবণ অঞ্চলে বসবাস করেন। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, কীভাবে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়াতে সংঘাত ভূমিকা রাখে। যুদ্ধ লোকজনকে বাস্তুচ্যুত করে দেয়, তাদের আয়ের উৎসগুলোকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়।

এরপরে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের আঘাত। এতে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে জীবন ও জীবিকা। আর করোনা মহামারির অর্থনৈতিক বিরূপ প্রভাব ক্ষুধাকে নজিরবিহীন পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে।

যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে খাদ্যমূল্যে দাম বেশি বেড়েছে। এরইমধ্যে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় চুক্তি হওয়ার পর কৃষ্ণসাগর বন্দর হয়ে খাদ্যশস্যের জাহাজ চলাচল করছে। এতে দ্রব্যমূল্য কমে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

বিভিন্ন দেশে মন্দার শঙ্কার মধ্যেই রাশিয়ায় বাম্পার ফলন হয়েছে। এতে পূর্ণ্যোদ্যমে খাদ্য রফতানি শুরু হলে দাম কমার সম্ভাবনা রয়েছে। দাম কমলেও যে খাদ্যসংকট মিটে যাচ্ছে; তা-ও কিন্তু না। বিশ্লেষকেরা বলছেন, যেসব অন্তর্নিহিত ঘটনায় জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, তাতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। বরং বহাল তবিয়তে রয়েছে। যে কারণে আপাতত শঙ্কা দূর হচ্ছে না।

আসছে দিনগুলোতে ক্ষুধার্তদের হার ঊর্ধ্বমুখী থাকার জন্য যেসব কারণকে দায়ী করা হচ্ছে, তার মধ্যে একটি চলমান যুদ্ধ। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই অনেকগুলো অনুঘটক নিহিত ছিল খাদ্যমূল্য বাড়ার পেছনে। শস্য উৎপাদনকারী প্রধান দেশগুলোতে খরার প্রভাব পড়েছে। আবার মহামারি চলে গেলেও তার যে পারিপার্শ্বিক প্রভাব থেকে গেছে, তাতে সরবরাহ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়েছে।

আর করোনার লকডাউনে বিপর্যস্ত অর্থনীতি ও দরিদ্র দেশগুলোতে যে ভয়ানক পরিস্থিতি ছিল, তা আরও চরমে নিয়ে গেছে যুদ্ধ। খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক মার্কিন বিশেষ দূত ক্যারি ফাউলার বলেন, আগের একইরকম পরিস্থিতি থেকে বর্তমান খাদ্য সংকটকে আলাদা করে দিয়েছে অনেকগুলো কারণ।

এসব অনুঘটকের প্রভাব আগামী বছরে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদন নিঃসন্দেহে কমিয়ে দিয়েছে যুদ্ধ। আবার ইউক্রেন যুদ্ধে বন্দরগুলোকে অবরুদ্ধ করে রাখা ও বিকল্প পথগুলো সীমিত থাকায় খাদ্য বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। রফতানির গতিও নেমে এসেছে আগের তুলনায়।

ইউক্রেনের কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গেল জুনে কেবল ১০ লাখ টন গম, ভুট্টা ও বার্লি রফতানি করেছে তারা। যা ২০২১ সালের একইমাসের তুলনায় চল্লিশ শতাংশ কম। নতুন ফসল মজুতে হিমশিম খেতে হচ্ছে উৎপাদকদের।

২০২৩ সাল আরও উদ্বেগের
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ বছরের চেয়ে ২০২৩ সাল নিয়ে উদ্বেগ আরও বেশি। কৃষকেরা যদি তাদের ফসল বিক্রি করতে না-পারেন, তবে তার পরোক্ষ প্রভাব পড়বে আগামী বছরে। কারণ পরের মৌসুমে বীজ ও সার কেনার অর্থ থাকবে না তাদের হাতে। আন্তর্জাতিক খাদ্য নীতির এক কর্মকর্তা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ইউক্রেনীয়রা একটি ফসলও উৎপাদন করতে সক্ষম হতে না-পারেন।

বসন্তের শেষ দিকে পণ্যমূল্য বেড়ে গেলে কৃষকেরা উৎপাদনে উৎসাহিত হবেন। এতে তারা উৎপাদন খরচও পুষিয়ে নিতে পারবেন। বিশেষ করে খামারের সরঞ্জামাদি, গাড়ির জ্বালানি ও সারের খরচ তুলে আনতে পারবেন তারা।

খাদ্য নীতি কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে জ্বালানির মূল্য যেভাবে বাড়ছে, আগামী শীতেও তা অব্যাহত থাকতে পারে। ফসলের একটি গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি হলো নাইট্রোজেন সার। জ্বালানির দাম বাড়লেও এই সার উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

কমে যাবে ক্রয় ক্ষমতা
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রধান অর্থনীতিবিদ আরিফ হোসেন বলেন, কৃষি উৎপাদনের সমস্যাগুলো দূর করতে না-পারলে—বিশেষ করে সারের ক্ষেত্রে—পরের বছর মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে। সবচেয়ে বড় উদ্বেগ এখন শস্য সরবরাহ—বিশেষ করে গম ও ভোজ্য তেল। এ দুটো পণ্যের সবচেয়ে বড় রফতানিকারক ইউক্রেন।

রফতানি নিষেধাজ্ঞার প্রভাব
চালের মূল্য নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। ভাত হলো এশীয়দের প্রধান খাবার। বেশ কিছু পণ্য উৎপাদনে এগিয়ে ভারত, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম। কিন্তু এসব দেশ রফতানি নিষেধাজ্ঞা দিলে পরিস্থিতির অবনমন ঘটতে পারে। গমের দাম বেশি হওয়ায় বিকল্প হিসেবে চালের দিকে ঝুঁকতে পারে ভোক্তারা। আর তখনই চালের ওপর রফতানি নিষেধাজ্ঞার শঙ্কা দেখা দিতে পারে।

বৈশ্বিক উৎপাদিত শস্যের কেবল ১০ শতাংশ রফতানি হয়ে আসছে। যদি কোনো রফতানিকারক দেশ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বসে, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে।

২০০৭ ও ২০০৮ সালে গম বিক্রিতে রফতানি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল ভারত ও ভিয়েতনাম। এ দুই দেশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ফিলিপিন্সও। এতে আতঙ্কিত হয়ে লোকজন প্রচুর খরিদ করতে শুরু করেন। আর দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়।

জাপানিজ বিনিয়োগ ব্যাংক নোমুরার বিশ্লেষকরা বলেন, আমরা নিবিড়ভাবে চালের দাম পর্যবেক্ষণ করছি। যদি গমের দাম বাড়ে, তাহলে মানুষ বিকল্প খুঁজবে চালে। এতে বিদ্যমান মজুত কমে যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত প্রধান চাল উৎপাদক দেশগুলো বিধিনিষেধ আরোপে বাধ্য হতে পারে। তাতে সবকিছুর দাম কয়েকগুণ বেড়ে যাবে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) জানিয়েছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আভিযানের বহু আগেই খাদ্য অনিরাপত্তা রেকর্ড স্পর্শ করে। মহামারি, খরা ও বিভিন্ন আঞ্চলিক সংঘাতে ২০২১ সালে ৭৭ কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত ছিল। ২০০৬ সাল থেকে যা সর্বোচ্চ।

বাড়ছে পুষ্টিহীনদের সংখ্যা
পূর্বাভাস দিয়ে এফএও বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধে চলতি বছরে পুষ্টিহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে এক কোটি ৩০ লাখ। ২০২৩ সালে বাড়বে আরও এক কোটি ৭০ লাখ। আর বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে, খাদ্যমূল্য প্রতি এক শতাংশ বেড়ে গেলে অতিরিক্ত এক কোটি মানুষ চরম দরিদ্র অবস্থার মধ্যে পড়ে যাবে।

আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ার অধিকাংশ অঞ্চলে খাদ্যদ্রব্যের ব্যবহার উৎপাদনকে ছাড়িয়ে যাবে। অর্থাৎ উৎপাদনের চেয়ে ভোক্তা বেশি থাকায় আরেক চাপ তৈরি হবে। পণ্য নিয়ে তথ্য সরবরাহকারী সংস্থা গ্রো ইন্টেলিজেন্স জানিয়েছে, এসব অঞ্চলের দেশগুলো সবচেয়ে বেশি বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধির ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া অনেক উদীয়মান অর্থনীতির দেশকে মুদ্রার মূল্য পড়ে যাওয়ার পাশাপাশি খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির বোঝাও বহন করতে হচ্ছে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বলছে, অপর্যাপ্ত খাবারের কারণে ৮২টি দেশের ৩৪ কোটি ৫০ লাখ মানুষ মৃত্যুর ঝুঁকিতে আছেন।
মহামারির আগের তুলনায় যা দ্বিগুণ।

সম্প্রতি বাজারে মূল্য কমলেও খাদ্য, জ্বালানি ও সার অনেক ব্যয়বহুল থাকবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মহাপরিচালক এনগোজি অকোঞ্জি-আইওয়েলা বলেন, আমরা পরিস্থিতির ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠেছে বলে দাবি করার সুযোগ নেই।

আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব
মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় কতটা প্রভাব পড়বে, তা নির্ভর করে ইউক্রেন-রাশিয়ার রফতানির ওপর। সহায়তার জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ হয়েছে মিসর। তুরস্কে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে ৮০ শতাংশ। আর বিশ্বব্যাংকের ভাষায়, গত ১০০ বছরে আসা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সংকটগুলোর একটি বর্তমানে লেবাননে।

রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে পণ্য কেনে না, কিন্তু কৃষি পণ্যে রফতানির চেয়ে আমদানি বেশি—এমন দেশগুলোকেও অতিরিক্ত রফতানি খরচ বহন করতে হচ্ছে। রুটি, পাস্তা ও রান্নার তেলের মতো প্রধান খাদ্যগুলোর দাম বাড়ছে দ্রুতগতিতে। জুনে বুলগেরিয়ায় একখণ্ড রুটির দাম আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। আর স্পেনে ভোজ্য তেলের অবস্থাও একই। পোল্যান্ডে চিনির দাম বেড়েছে চল্লিশ শতাংশ।

খাবার কিনতেই ভোক্তাদের পকেট ফাঁকা
নিম্ন-আয়ের দেশগুলোতে ভোক্তাদের খরচের বড় অংশই চলে যায় খাবার কিনতে। জীবনযাত্রার মূল্য বেড়ে গেলেও এতে খরচ কমিয়ে আনা কঠিন হয়ে যায়। মিসরের পরিবারগুলোতে খরচের এক-তৃতীয়াংশের জন্য দায়ী খাদ্য ও অ-অ্যালকোহলিক পানীয়। আর খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বেড়েছে ২৪ শতাংশ। ইথিওপিয়ার পরিবারগুলোতে খাবারে বেশি অর্থ বরাদ্দ রাখতে হলেও বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ৩৮ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদ আরিফ হোসেন বলেন, যদি আপনি এমন কোনো দেশে বাস করেন, যেখানে দিনে আপনার ব্যয় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বেড়ে যাচ্ছে, তবে সেখানে ধাক্কা সামলানোর মতো কোনো ফুরসত থাকল না।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিলের সভাপতি গিলবার্ট হাউঙ্গবো বলেন, আফ্রিকায় বিশেষ করে আগামী বছর দুর্ভিক্ষের শঙ্কা রয়েছে। এতে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। এছাড়া এতে অর্থনৈতিক অভিবাসনের সংখ্যাও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

দাম বাড়ায় দাঙ্গা-অস্থিরতা
২০০৭ ও ২০০৮ সাল ও ২০১০ ও ২০১১ সালেও খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেলে দেশে দেশে দাঙ্গা দেখা দেয়। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার উত্তাল বিক্ষোভের জন্য আকাশছোঁয়া খাদ্যমূল অনুঘটকের ভূমিকা রেখেছে। মানুষের ক্ষোভ থেকে বাঁচতে কোনো কোনো দেশে ভর্তুকি দিয়ে সামাজিক অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।

বহুজাতিক ব্যাংক বারক্লেইসের বিশ্লেষক মিখাইল পন্ড বলেন, ভর্তুকির মতো অস্থায়ী সহায়তা দিয়ে বড়ো কোনো সমাধানে আসা যায় না। বরং এতে সুদূরপ্রসারী একটি প্রভাব রয়ে যায়। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারি সহায়তার চেয়েও চাপ অনেক বেশি হয়। সরকারি সহায়তা দিয়ে অর্থনৈতিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সবকিছু নাগালের বাইরে চলে যায়।

আশার আলো দেখাচ্ছেন কেউ কেউ
পরিস্থিতি অনেক ভয়াবহ হচ্ছে; সবাই এমনটা মনে করছেন না। জুলাইয়ের শুরুতে ভবিষ্যৎ খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে একটি আশাবাদী প্রতিবেদন দিয়েছে আর্থিক কোম্পানি মর্গান স্ট্যানলি। তাতে বলা হয়ছে, আগামী বছরে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি প্রত্যাশার চেয়ে কম হবে। ইউক্রেনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি সংঘাত কমে গেলে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।

কৃষ্ণসাগর বন্দর দিয়ে ইউক্রেনের খাদ্য রফতানি শুরু হওয়ায় মানুষের মধ্যে কিছুটা আশার আলো জেগেছে। যদিও ইউক্রেন যুদ্ধ এখনো পুরোদমে চলছে। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হলেও দেশটির কৃষি ও বন্দর কাঠামো পুনর্নিমাণ করতে হবে। আর জলপথ থেকে মাইন অপসারণ করতে হবে। এসব কাজ শেষ না হলে দেশটির নাগরিকেরা তাদের ভূমিতে কাজে ফিরতে পারবেন না।

দুঃস্বপ্ন থেকেই যাচ্ছে সুদূরপ্রসারী
পশ্চিমা সরকারি কর্মকর্তাদের ধারণা, চলমান খাদ্য সংকট বহুবছর স্থায়ী হবে। কারণ যুদ্ধের সঙ্গে যোগ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারিসহ বিভিন্ন সংঘাতের প্রভাব। কাজেই এসব অনুঘটকের কোনো একটির প্রভাবে মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকতে পারে।

চ্যাটাম হাউসের জ্যেষ্ঠ গবেষক লৌরা ওয়েলেসলি বলেন, যেসব দেশ খাদ্যশস্য, ভোজ্যতেলের জন্য ইউক্রেনের ওপর নির্ভরশীল, তাদের আমদানির উৎসগুলোতে বৈচিত্র্য এনেও কোনো সুরাহা হবে না। অর্থাৎ দীর্ঘসময় ধরে পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। জ্বালানির ক্ষেত্রেও কাহিনী একই থাকবে। সার্বিক দৃশ্যপট বলে দিচ্ছে যে, যদি একটি পণ্যের সরবরাহে কড়াকড়ি আসে, তবে অপরিহার্যভাবে দাম বেড়ে যাবে। খুব দ্রুতই এ পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না।

হুঁশিয়ারি দিয়ে অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, খাদ্যপণ্যের স্থায়ী উচ্চমূল্যের সঙ্গে অভ্যস্ত হতে হবে ভোক্তাদের। ক্যাপিটাল ইকনোমিক্স কোম্পানি পূর্বাভাস দিয়েছে, মার্কেট পর্যায়ে দাম ঐতিহাসিকভাবে উচ্চপর্যায়ে থাকবে। কিন্তু আবহাওয়ার অস্থিতিশীলতা বাড়ছে।

অর্থনীতিবিদ ক্যারোলিন বিয়েইন বলেন, গেল কয়েক বছরে ফসল উৎপাদন কম ছিল বলে আমরা দেখেছি, যা অস্বীকার করা সুযোগ নেই। সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান ধাক্কা রয়েছে।
কম দামের পণ্য সরবরাহের বাণিজ্য ব্যবস্থা ভেঙে দিতেই সংঘাত শুরু হয়েছে কিনা; তা ভেবে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। কারণ চলমান যুদ্ধের কারণে ভূমণ্ডলের প্রতিটি কোণের খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

গবেষক লরা ওয়েলেসলি বলেন, বৈশ্বিক খাদ্য বাণিজ্য ব্যবস্থা দ্রুতই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে না। আর এতে সব ধরনের খাদ্যপণ্য সরবরাহ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
খাদ্যপণ্য ও সারের মূল্যবৃদ্ধি বহুদিন অব্যাহত থাকবে বলেই ধরে নেয়া যায়। বাণিজ্য নির্ভরশীলতারও পুনর্বিন্যাস ঘটতে থাকবে। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে আঞ্চলিক সরবরাহ ব্যবস্থায় বেশি নজর দেয়া হতে পারে।

শেয়ার করুন