২৯ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ০২:৩০:৩৯ পূর্বাহ্ন
রাবি ছাত্রলীগের সম্মেলন: পদপ্রত্যাশীদের দৌড়ঝাঁপ, সভা-শোডাউনে দিন পার
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩০-১০-২০২২
রাবি ছাত্রলীগের সম্মেলন: পদপ্রত্যাশীদের দৌড়ঝাঁপ, সভা-শোডাউনে দিন পার

প্রায় অর্ধযুগ পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ছাত্রলীগের ২৬ তম সম্মেলনের ঘোষণা দিয়েছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। আগামী ১২ নভেম্বর রাবি ছাত্রলীগের সম্মেলনের দিন ঠিক করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সম্মেলনকে কেন্দ্র করে উপরমহলে পদপ্রত্যাশীদের নেতাদের দোড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেছে। ক্যাম্পাসে অনুসারীদের নিয়ে নিয়মিত শোডাউন দিচ্ছেন তারা। দিনরাত ক্যাম্পাসে চলছে বিভিন্ন পদপ্রত্যাশী ভাইয়ের নামে স্লোগান। ক্যাম্পাসে বিভিন্ন জায়গায় টাঙানো হয়েছে ব্যানার, হলের ব্লকে ব্লকে চলছে নেতাদের পোস্টার সাঁটানো। কে হবেন সভাপতি, কে হবেন সাধারণ সম্পাদক? এনিয়ে রাবি ক্যাম্পাসে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা।

সরেজমিনে ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা যায়, সম্মেলনের দিন ঘোষণার পর থেকে রাবি শাখা ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী নেতারা ক্যাম্পাসে বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। ক্যাম্পাসে নিজ অনুসারীদের নিয়ে দিচ্ছেন শোডাউন। মোটরসাইকেলে চড়ে ক্যাম্পাসে চলছে নেতাদের নামে স্লোগান। ক্যাম্পাসের প্রধান ফটক, প্যারিস রোডসহ বিভিন্ন চত্বর ছেঁয়ে গেছে ব্যানারে, আবসিক হলের ব্লকে ব্লকে চলছে পোস্টার সাঁটানো। এছাড়া পদপ্রত্যাশীরা নিজ নিজ জায়গা থেকে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেকেই আবার অনুসারীদের নিয়ে বিভিন্ন মিছিল, মিটিং, সমাবেশ করছেন। কেউ সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে বিভিন্ন ধরনের কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন সমাবেশ থেকে।

রাবি ছাত্রলীগ সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর রাবি শাখা ছাত্রলীগের ২৫তম সম্মেলন হয়। সম্মেলনের ৩ দিন পর গোলাম কিবরিয়াকে সভাপতি ও ফয়সাল আহমেদ রুনুকে সাধারণ সম্পাদক করে এক বছর মেয়াদী ১৩ সদস্যের আংশিক কমিটি দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। পরবর্তীতে প্রায় ছয় মাস পর ২০১৭ সালের ১৯ জুন ২৫১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়া হয়। প্রায় দীর্ঘ ৬ বছর পর গত ২৫ অক্টোবর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আগামী ১২ নভেম্বর রাবি শাখা ছাত্রলীগের ২৬ তম সম্মেলনের ঘোষণা দেন।

ক্যাম্পাস সূত্র জানায়, রাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদ পেতে দৌড়ে এগিয়ে আছেন একাধিক নেতা। তারা হলেন, বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি কাজী আমিনুল হক লিংকন, জাকিরুল ইসলাম জ্যাক ও মেসবাহুল ইসলাম। যুগ্ম-সাধারণ হলেন শাহিনুর সরকার ডন, ফয়েজ আহমেদ, শেখ মামুন। সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান মিশু, ইমতিয়াজ আহমেদ ও এনায়েত হক রাজু। সক্রিয়দের মধ্যে আরও যারা আছেন উপধর্ম-বিষয়ক সম্পাদক তাওহীদুল ইসলাম দুর্জয়, সহ-সম্পাদক সৌমিক সরওয়ার সম্রাট, প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক আসাদুল্লাহ হিল গালিব ও কার্যনির্বাহী সদস্য আল মুক্তাদির তরঙ্গ, মাদারবখ্শ হল শাখা কমিটির সহ-সভাপতি সাজ্জাদ হোসেন। এছাড়াও বিভিন্ন হল শাখা কমিটির নেতারা নতুন কমিটির নেতৃত্বে আসার জন্য জীবনবৃত্তান্ত তুলেছেন।

রাবি শাখা ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী নেতাদের একাংশ জানান, ২০১৬ সালের কমিটির মেয়াদ একবছর থাকলেও তা ছাড়িয়ে যায় দীর্ঘ প্রায় ৫ বছর। এতে করে ওই কমিটির পদধারী নেতাকর্মীদের বেশিরভাগই ছাত্রত্ব শেষ হয়ে গেছে। অধিকাংশই চাকরি, ব্যবসা, ঠিকাদারিসহ নানা পেশায় জড়িয়ে ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। কিছুসংখ্যক আবার স্ব্যান্ধ্যকালীন মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে ক্যাম্পাসে রয়েছেন। আবার অনেকেই সম্মেলনের দিন ধার্য হওয়ার কারণে ক্যাম্পাসে ফেরত এসেছেন, অনুসারীদের নিয়ে দিচ্ছেন শোডাউন। এমতাবস্থায় যাচাই-বাছাই করে শুধুমাত্র নিয়মিত শিক্ষার্থীকেই যেনো ছাত্রলীগের রাজনীতিতে আনা হয় সেই দাবি তাদের। এছাড়াও কিছুসংখ্যক নেতার অভিযোগ, রাজশাহীর স্থানীয় নেতাদের ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে নির্বাচনের প্রবণতা রয়েছে। এক্ষেত্রে কোনোরকম স্থানীয় নেতাদের তদবির ছাড়া শুধুমাত্র যোগ্য প্রার্থীকেই শীর্ষপদে আনার দাবি তাদের।

রাবি শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশী মো. মেসবাহুল ইসলাম। তিনি কালের কণ্ঠকে জানান, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সমসাময়িক যেসব বিষয়ে তীব্র সমালোচনার শিকার হয়েছে, সেগুলোর বিপক্ষে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করবো। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলে ক্যাম্পাসের সমস্যাগুলো নিয়ে সভাপতির সঙ্গে বৃহৎ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করবো এবং তা লিপিবদ্ধ করে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সমাধানের চেষ্টা করবো।

নতুন কমিটিতে সভাপতি পদপ্রত্যাশী সৌমিক সরওয়ার সম্রাট কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘‘আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সকল ইতিবাচক কাজ করে প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করবো।

সভাপতি পদপ্রত্যাশী আরেক নেতা ফয়েজ আহমেদ বলেন, একজন ছাত্রনেতা হিসেবে শিক্ষার্থীদের হল সমস্যা, আর্থিক সমস্যাসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে সহযোগিতার হাত বাড়াবো। আমি চাই, রাবি ছাত্রলীগ দেশরত্নের ভ্যানগার্ড হয়ে রাজশাহীর অভিভাবক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের দিকনির্দেশনায় ছাত্রদের অধিকার নিয়ে কাজ করতে। সভাপতি হিসেবে আমার অঙ্গীকার সুষ্ঠু  ও ছাত্রবান্ধব ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা।

ছাত্রলীগের নতুন কমিটির নেতৃত্ব নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বললে তারা কালের কণ্ঠকে জানান, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থী তাদেরকেই নেতৃত্বে প্রাধান্য দেয়া উচিত। এক্ষেত্রে সৎ, ন্যায়নীতিপরায়ণ, স্বচ্ছ মনোভাব, মেধাবী, শিক্ষার্থীবান্ধব, নেতৃত্বে যোগ্যতাসমপন্ন শিক্ষার্থীকেই নেতা বানানোর দাবি তাদের।

রাবি আইনবিভাগের শিক্ষার্থী আশিকউল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, যারা হলের সিট বাণিজ্যে জড়িত থাকবে না, ক্যাম্পাসে চাঁদাবাজি করবে না, নেতৃত্বদানে দক্ষ হবে তাদেরকেই নেতা হওয়া উচিত। পাশাপাশি তাদেরকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে হবে।

রাবি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুলতান মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, বর্তমান ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের রাজনীতি নাজুক অবস্থায় আছে। এক্ষেত্রে গণতন্ত্র ও দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সম্মেলন দিয়ে কমিটি দেওয়া উচিত। ছাত্রত্বহীনরা নেতৃত্বে চলে আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা কাজের চেয়ে নিজের স¦ার্থকে বেশি গুরুত্ব দেবে। এজন্য নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে নেতার আচার-আচরণ, মাদকসেবী কিনা, ন্যায়-নীতিপরায়ণ, শিক্ষক-বন্ধুদের সঙ্গে তার ব্যবহার; এই প্রত্যেকটা বিষয় গুরুত্ব দেয়া উচিত।

এদিকে সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সাধারণ শোডাইনের পাশাপাশি ক্যাম্পাসে চলছে মোটরসাইকেল শোডাইন। এতে ক্যাম্পাসের সড়কে যানযট, ধুলোবালির সৃষ্টি হচ্ছে। ক্যাম্পাসে সড়কের পাশে অ্যাকাডেমিক ভবনগুলো রয়েছে। এসব ভবনে শোডাউনের শব্দে শ্রেণি কার্যক্রম ও পরীক্ষা দিতে সমস্যা হচ্ছে সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।

এ বিষয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী আজিম কালের কণ্ঠকে বলেন, পরীক্ষা চলাকালে ক্যাম্পাসে মোটরসাইকেলের শোডাউনের কারণে পরীক্ষায় মনোযোগ নষ্ট হয়। অ্যাকাডেমিক ভবনগুলোর সামনে ক্লাস ও পরীক্ষা চলাকালে কোনো ধরনের শোডাউন না দেওয়ার দাবি তার।

এদিকে রাবিতে নতুন কমিটিতে পদপ্রত্যাশী নেতাকর্মীদের জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ করতে এসেছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের তিন নেতা। তারা হলেন, কেন্দ্রীয় শাখার মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণা সম্পাদক মেহেদী হাসান তাপস, সহ-সম্পাদক আফি আজাদ বান্টি ও আহসান হাবীব বাপ্পি।

রাবি শাখা ছাত্রলীগের সম্মেলন ও নতুন কমিটি নিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণা সম্পাদক মেহেদি হাসান তাপস কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন যারা ছাত্রলীগের সঙ্গে ছিলো, যাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যার সমপৃক্ততা ও ক্যাম্পাসে যার জনপ্রিয়তা আছে। এর পাশাপাশি যারা নিয়মিত শিক্ষার্থী, তাদের মধ্যে থেকে নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে।’  স্থানীয়দের শীর্ষপদে নিয়ে আসার অভিযোগের বিষয়ে এই নেতা বলেন, ‘যোগ্যতার ভিত্তিতে ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে আনা হয়। এখানে স্থানীয় বা অঞ্চলভেদে শীর্ষপদে আসার কোনো সুযোগ নাই।’

রাবি উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ছাত্রলীগের নেতৃত্ব তাদের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী হবে। তবে শিক্ষক হিসেবে একজন প্রকৃত ছাত্রকে আমি নেতা হিসেবে চাই। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে যেই আসুক, তার প্রথম পরিচয় সে ছাত্র। যার ভিতরে ছাত্রবান্ধব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তার নিজ দলকে মান্য করে এবং অন্যকে মান্য করার জন্য অনুপ্রাণিত করে। বিশেষ করে ছাত্রদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা, লেখাপড়া, সাংস্কৃতিচর্চায় তার ভুমিকা থাকবে।

শেয়ার করুন