২৯ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ০৮:০৪:৫১ অপরাহ্ন
দীর্ঘমেয়াদে ভুগতে হবে সোনাইছড়িকে
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৬-০৬-২০২২
দীর্ঘমেয়াদে ভুগতে হবে সোনাইছড়িকে

কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের কারণে বিস্ফোরণের ঘটনায় দীর্ঘদিনের জন্য ক্ষতির শিকার হয়েছে সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ও আশপাশের এলাকা। বিস্ফোরণের ভয়াবহতা টের পেয়েছে আড়াই বর্গকিলোমিটার এলাকার মানুষ। দূরবর্তী প্রভাব পড়েছে ১০ বর্গকিলোমিটার এলাকায়। পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোর বিভিন্ন স্থাপনা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। এতে সেগুলোর স্থায়িত্বকাল কমে যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গাছপালা। ওইসব এলাকার মানুষকে দীর্ঘমেয়াদে নানা সমস্যায় ভুগতে হবে। তাদের বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। এদিকে রাসায়নিক যাতে সমুদ্রে গিয়ে না পড়ে, সেই কাজ চলছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাসায়নিক সংরক্ষণে যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ না করায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। ডিপো কর্তৃপক্ষের অবহেলা-অব্যবস্থাপনায় দুর্ঘটনা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। তদারক সংস্থাগুলোরও গাফিলতি রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জনবসতিপূর্ণ এলাকায় রাসায়নিক সংরক্ষণ সম্পূর্ণরূপে অবৈজ্ঞানিক। লোকালয়ের মধ্যে এগুলো কোনোভাবেই রাখা যায় না। সামান্য অগ্নিনিরাপত্তা প্রস্তুতিও সেখানে ছিল বলে মনে হয়নি। আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসকে সংরক্ষিত রাসায়নিকের বিষয়ে পরিষ্কার তথ্য না দেওয়া তাদের খামখেয়ালিপনার বহিঃপ্রকাশ। এ কারণেই হতাহত বেশি। রাসায়নিকের আগুন নিয়ন্ত্রণে পানির ব্যবহার ছাড়া অন্য যেসব করণীয় আছে, সেগুলো নিয়ে ভাবতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস।

জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল যুগান্তরকে বলেন, রাসায়নিক শ্রেণিভুক্ত করে সংরক্ষণের যে পদ্ধতি, তা আমাদের দেশে অনুসরণ করা হয় না। কখনো কখনো দেখা যায়, গুদামের মধ্যে দাহ্য রাসায়নিক রাখা হয়। ফলে সামান্য স্ফুলিঙ্গ থেকেই বড় ধরনের বিস্ফোরণ বা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সেই ধরনের অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার কারণেই সীতাকুণ্ডের ডিপোতে বিস্ফোরণ হয়েছে। সেখানে যে প্রটেকশন নেওয়া দরকার ছিল, তা ছিল না বিধায় মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এই বিস্ফোরণের কারণে এলাকায় যত ধরনের স্থাপনা আছে প্রত্যেকটির স্থায়িত্বকাল কমে যাবে। কারণ এ ধরনের ম্যাসিভ বিস্ফোরণ হলে তা থেকে ছড়িয়ে পড়া উত্তাপে সেখানকার নির্মাণসামগ্রীর যে বন্ডিং, সেটা দুর্বল হয়ে যায়। সেকারণে এগুলো লাইফটাইম (বয়সকাল) বহুলাংশে কমে যায়।

তিনি বলেন, একটা বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের জন্য হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড সোর্স হিসাবে বা ট্রিগারিং ফ্যাক্ট হিসাবে কাজ করে। হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডকে বলা হয় অক্সিডাউজিং এজেন্ট। এটা নিজে দাহ্য না, কিন্তু এর মধ্যে যদি কোনো ইমপিউরিটিস থাকে, যদি সেখানে অন্য রাসায়নিক থাকে, তাহলে সেটা হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডকে ডিকম্পোজ (বিক্রিয়া) করে। সেই বিক্রিয়া থেকে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, সেখানে যে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ছিল, সেগুলো পিওর ছিল না। অথবা সেখানে অন্য কোনো রাসায়নিক থাকার কারণে প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন জেনারেশন হয়েছে। এই অক্সিজেনটাই প্রকৃত অর্থে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের কারণ হয়েছে।

মাকসুদ কামাল বলেন, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড সংরক্ষণে প্রপার ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা সংবলিত জায়গা দরকার, নাহলে সমস্যা হতে পারে। এখানে ক্যাটাগরিজ করে দিতে হবে, কোন রাসায়নিক কীভাবে কোথায় রাখতে হবে। যেখানে কেমিক্যালগুলো থাকবে, সেখানে রেড ব্লক, গ্রিন ব্লক-এরকম ব্লকিং করে দিতে হবে। দেখা যায়, সতর্কতা যেটা অবলম্বন করার কথা, রেড জোনে যেটা থাকবে, গ্রিন জোনে কম সতর্কতা থাকবে। ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে অবগত করতে হবে। তখন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ সহজ হয়। যদি এগুলো না করা হয়, তাহলে সেফটি মেজার যারা নেবেন, তাদের জন্য কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন, সেটি বুঝবে না। সীতাকুণ্ডেও সতর্কতা না থাকার কারণে এবং জোনিং না করার কারণে বাড়তি সতর্কতা গ্রহণ সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এ কারণে আগুন লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

রাসায়নিক আগুন নির্বাপণের কৌশল উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোথাও আগুনের কারণে যদি রাসায়নিকে রিঅ্যাকশন হয়, তাহলে এর ভয়াবহতা অনেক বেশি বেড়ে যায়। যেহেতু সেখানে রাসায়নিকের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অংশ হিসাবে আগুন লেগেছে, তাই সেটি বন্ধের জন্য এবং আগুনের ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণের জন্য পানির বাইরে অন্য ধরনের রাসায়নিক, এক ধরনের ফোম ব্যবহার করা হয়। আমাদের সেই অভিজ্ঞতায় ঘাটতি এবং সঠিক তথ্য না পাওয়ায় বিস্ফোরণ ভয়াবহ হয়েছে। আগুন লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। অন্য রাসায়নিক দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা যদি ফায়ার সার্ভিসের থেকে থাকেও, তাহলে দুর্ঘটনাস্থলে সংরক্ষণ করার রাসায়নিক সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা না পেলে তাদের কিছু করার থাকে না। সেখানে হ্যাজার্ডাস সাবসটেন্স রেখে অন্য রাসায়নিক, এলিমেন্ট বা মেটালের সঙ্গে বিক্রিয়া করে একটা অক্সিডাইজিং এনভায়রনমেন্ট (দাহ্য হওয়ার মতো পরিবেশ) সৃষ্টি হয়।

ডিপোতে আগুন লাগার পর বিস্ফোরণে আশপাশের এলাকার বিভিন্ন ঘর ও ভবনের কাচের জানালা ভেঙে গেছে। অনেকের টিভি, ফ্রিজ ও বৈদ্যুতিক পাখা নষ্ট হয়েছে। বিস্ফোরণের পর থেকে কালো ধোঁয়া আর কেমিক্যালের পোড়া গন্ধে ছড়িয়ে পড়েছে। পোড়া গন্ধে বেশি সমস্যায় পড়েছেন শিশু ও বৃদ্ধরা। তাই অনেককে মুখে মাস্ক পরে থাকতে দেখা গেছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আফতাব আলী শেখ বলেন, দুইভাবে প্রতিক্রিয়া হয়েছে। হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড অক্সিডাইজিং এজেন্ট এবং রিডিউসিং এজেন্ট হিসাবে কাজ করেছে। ফলে প্রতিক্রিয়া বেশি হয়েছে। একভাবে হলে প্রতিক্রিয়া কম হতো। তিনি বলেন, এই বিস্ফোরণের কারণে আশাপাশের এলাকাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিল্ডিংয়ের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসে কিছু সমস্যা হবে। এ অবস্থা রোধে মানুষজনকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে হবে। তাদের সেখানে অবস্থান ঠিক হবে না। এসবের পাশাপাশি যে গ্যাস ছড়িয়ে পড়েছে, সেগুলো সম্পর্কে ধারণা নিয়ে করণীয় নির্ধারণ করতে হবে।

শেয়ার করুন