সরকার পতনের দাবিতে বিএনপির এক দফার বিপরীতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও এক দফা ঘোষণা করেছে। তাদের এক দফা হলো— সংবিধানের অধীনে নির্বাচন। গতকাল রাজধানীর বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে শান্তি সমাবেশ থেকে এই এক দফা ঘোষণা করেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের আয়োজনে শান্তি সমাবেশটি অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘আমাদেরও এক দফা—সংবিধানসম্মত নির্বাচন। এই লক্ষ্য সামনে রেখে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।’
বিএনপির দাবির প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘তাদের এক দফা হলো—শেখ হাসিনার পদত্যাগ।
আমাদেরও দফা একটা—শেখ হাসিনা ছাড়া কোনো নির্বাচন মানব না। নির্বাচন শেখ হাসিনার আমলেই হবে।
বাংলাদেশের মানুষ যাঁকে ভালোবাসে, বাংলাদেশের জনগণ যে নেত্রীর সততাকে পছন্দ করে, সেই শেখ হাসিনা নির্বাচনে নেতৃত্ব দেবেন।’
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিএনপি জানে নির্বাচন করলে তারা হেরে যাবে, শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তার কাছে তারা হেরে যাবে।
আর সে জন্যই তারা শেখ হাসিনাকে হিংসা করে। শেখ হাসিনার অপরাধ উন্নয়ন, অর্জন। শেখ হাসিনার অপরাধ ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন দেখেছেন তিনি।’
রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশ প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন, আজকেও কাঁথা-বালিশ নিয়ে অনেক লোক আনার চেষ্টা করেছে। বিএনপি স্বপ্ন দেখেছিল আন্দোলনের।
সে স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত গরুর হাটে সমাপ্তি ঘটেছে। আরেক স্বপ্ন দেখছে—শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার। পল্টনে আজ বৃষ্টি হয়েছে। তাদের ওই স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত নয়াপল্টনে কাদাপানিতে আটকে গেছে।
বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচি প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘কোনো বাধা দেব না। কাউকে আক্রমণ করতে যাব না। ঢাকায় বিদেশি বন্ধুরা এসেছে। তাদের উদ্দেশে বলতে চাই—আপনারা চান সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন। আমাদের লক্ষ্যও অবাধ, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ নির্বাচন। যারা এই অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনকে বাধা দিতে আসবে আমরা তাদেরকে প্রতিহত করব।’
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘খেলা হবে নির্বাচন পর্যন্ত। মাঠ ছাড়বেন না। শেখ হাসিনা যখনই ডাক দেবে আপনারা তখনই মাঠে চলে আসবেন। শেখ হাসিনা কারো সঙ্গে আপস করবে না।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘যাদের হাতে রক্তের দাগ তাদের সঙ্গে যা-ই হোক, কোনো সংলাপ নয়। যারা জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ড, তার আগে ১৫ আগস্ট ঘটিয়েছে, তাদের সঙ্গে আমরা আপস করতে পারি না। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের সঙ্গে আপস করতে পারি না।’
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমরা জয় বাংলা স্লোগানের সঙ্গে, ৭ মার্চের চেতনার সঙ্গে আপস করতে পারি না। আমরা বঙ্গবন্ধুর রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করতে পারি না। যারা আমাদের পিতার রক্ত ঝরিয়েছে, তাদের সঙ্গে আপস নয়। আমাদের নেত্রী অনেক মহানুভবতা দেখিয়েছেন। ২১ আগস্ট উনাকে হত্যার জন্য গ্রেনেড হামলার পরও কোকোর মৃত্যুতে শোক জানাতে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। ঘরের দরজা বন্ধ, বাইরের গেট বন্ধ!’
দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যখন খেলতে নামবে তখন কোনো অপশক্তি সামনে দাঁড়াতে পারবে না। তৈরি হয়ে যান, প্রস্তুত হয়ে যান। একটানা প্রগ্রাম। এখন জুলাই, সামনে শোকের মাস আগস্ট, এর পরে সেপ্টেম্বর। একেক সময় একেক রকমের কর্মসূচি আসতে পারে। শোকের মাসে শোকের কর্মসূচি। পাশাপাশি জনসংযোগ কর্মসূচি চলবে।’
শান্তি সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী এবং সঞ্চালনা করেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান। বক্তব্য দেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাক, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, কামরুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আব্দুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ ও মাহবুবউল আলম হানিফ, সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস প্রমুখ।
সভাপতিণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘ওই হত্যাকারীর দল, ওই ঘাতকরা আবারও নেমেছে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল করার জন্য। যে হাত আগুন দেবে, সেই হাত ভেঙে দেব। এই জবাব দেওয়ার জন্য আজকের এই শান্তি সমাবেশ।’ সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য কামরুল ইসলাম বলেন, ‘নির্বাচন হবে সংবিধান অনুযায়ী। পদত্যাগের প্রশ্নই আসে না। বাংলাদেশ কারো করদ রাজ্য নয়।’ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেন, বিএনপি ২০১৩ সালে এক দফা ঘোষণা করেছিল, ২০১৪ সালে করেছিল। ২০১৫ সালে করেছিল। ২০১৯ সালেও এক দফা ঘোষণা করেছিল। কয়েক দিন আগেও এক দফা ঘোষণা করেছে। তাদের এক দফা বেলুন ফোটার মতো ফুটে গেছে।
মঞ্চ ও আশপাশে বিশৃঙ্খলা : সমাবেশ শুরুর নির্ধারিত সময় ছিল বিকেল ৩টা। নেতাকর্মীরা এর আগেই সমাবেশস্থলে এসে হাজির হতে থাকে। দুপুর ২টার আগেই মঞ্চের সামনে চেয়ার দখলকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে মারধর শুরু হয়। পরে মহানগরের একাধিক নেতার হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। দলীয় একাধিক সূত্র মতে, সংঘর্ষে জড়ানো নেতাকর্মীরা ঢাকার অদূরে রূপগঞ্জ উপজেলার একজন নেতার অনুসারী।
সমাবেশ চলার পুরো সময়েই মঞ্চে বিশৃঙ্খলা দেখা যায়। কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্যের সময় মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের বেশ কয়েকজন সম্পাদক পর্যায়ের নেতা ডায়াসের পাশে জটলা পাকান। মঞ্চে দাঁড়ানো কেন্দ্রীয় নেতারাও মহানগরের নেতাদের ভিড়ের চাপে পড়েন। এমন বিশৃঙ্খলায় ক্ষুব্ধ হন ওবায়দুল কাদের। বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকবেন। আমি এমন মঞ্চ দেখতে চাই না। এত নেতা আমার দরকার নাই। একটা মিটিংয়ে এত বক্তারও দরকার নাই। একেক প্রগ্রামে একেকজনকে বক্তব্য দিতে দেবেন। আর সামনের লোক ত্যক্তবিরক্ত হয়ে চলে যাবেন, এটা হয় না।’
সমাবেশে নেতাকর্মীদের ঢল : সমাবেশে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী উপস্থিত হন। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের প্রতিটি থানা, ওয়ার্ডের নেতাকর্মী ছাড়াও আশপাশের জেলা, উপজেলা থেকেও নেতাকর্মীরা সমাবেশে যোগ দেন। দুপুর একটার আগে থেকেই বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ডের নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে বায়তুল মোকাররমের গেটের দিকে আসতে থাকেন। দুপুর ২টার পরই রাজধানীর জিরো পয়েন্ট থেকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের দিকে রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আশপাশের সড়কগুলোতেও যান চলাচল সীমিত হয়ে পড়ে।
ঢাকা জেলা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ থেকেও নেতাকর্মীরা সমাবেশে এসে যোগ দেন। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বিশাল মিছিল নিয়ে সমাবেশে উপস্থিত হন। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুব মহিলা লীগসহ আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরাও মিছিলসহ সমাবেশে যোগ দেন। বিকেল ৩টায় সমাবেশ শুরুর পর সাড়ে ৪টা পর্যন্ত বিভিন্ন ওয়ার্ড ও থানা থেকে মিছিল নিয়ে নেতাকর্মীদের সমাবেশে যোগ দিতে দেখা যায়। পুরানা পল্টন মোড় হয়ে জিরো পয়েন্ট থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, বায়তুল মোকাররমের আশপাশের রাস্তাগুলোতে নেতাকর্মীদের উপস্থিতির কারণে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।